বুধবার, অক্টোবর ২২, ২০২৫

আমরা যুদ্ধ চাই না,যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী চাই

  • এম এ আলীম সরকার
  • ২০২৫-১০-২০ ০৯:০৪:৪০

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন আরম্ভ, তখন পশ্চিমা বৃহৎশক্তিবর্গ যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালাতেন। তারা পশ্চিমা বৃহৎশক্তিবর্গের চিন্তাধারা ও কাজ পৃথিবীতে যুদ্ধ ঘটিয়ে চলছে ও সম্পূর্ণ বিরোধী করে যুদ্ধজোট যুদ্ধবিরোধী  মানবতা প্রচার করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভুতি রাষ্ট্র যুদ্ধবিরোধী মানবজাতি গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক প্রচার চালাতো। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে দেখা গেল, পশ্চিমা শক্তিগুলো যুদ্ধ না শান্তি এই স্লোগান সবচেয়ে বেশি করে  চালাতে থাকলে শান্তির প্রশ্নে বেশি কথা বলা হলেও, যুদ্ধে  জয়ী হওয়া তাদের মূল প্রস্তুতি ছিল। যুদ্ধজোট যুদ্ধ অস্ত্র তৈরি, অস্ত্র বিক্রি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী হিসেবে  গড়ে তোলা হয়েছে। তখন আগের ধারাবাহিকতায় যুদ্ধজোট বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা ক্রমে বড় হচ্ছে। যুদ্ধে অস্ত্র তৈরি করার কাজ আরও বড় হচ্ছে এবং যুদ্ধজোট দ্রুত বড় হচ্ছে।  ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও বড় হচ্ছে এবং বেশি করে অস্ত্র তৈরি করছে। ব্যবসায়ী স্বার্থে যুদ্ধের আয়োজনে তারা বেশি সক্রিয় হয়েছে এবং শান্তির স্বপক্ষদের তা ক্রমাগত শক্তি  হারাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ ও এশিয়ায় যুদ্ধের অস্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় পারস্পরিক সহযোগিতায় যুদ্ধের আয়োজন ও উৎপাদিত অস্ত্র বিক্রির আয়োজন করছে। 
আজকের পৃথিবী উন্নয়নের দিক থেকে অনেকদূর এগিয়েছে। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা, প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা, কৃষি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে নবজাগরণ-সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়, আমরা একটি সভ্য, উন্নত, ও শান্তিপূর্ণ সমাজে বসবাস করছি। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। একবিংশ শতাব্দীতেও যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাত আর ধ্বংসযজ্ঞ পৃথিবীর নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে মানবসভ্যতার মূল বার্তা হওয়া উচিত ভালোবাসা, সম্প্রীতি,  সহানুভূতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা-সেখানে কিছু রাষ্ট্র বা ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যুদ্ধকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এই যুদ্ধের ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ, যারা শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ চায়।
আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ কখনোই কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। বরং যুদ্ধ সৃষ্টি করে নতুন নতুন সমস্যা, বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় মানুষের দুঃখ-কষ্ট। যুদ্ধের শিকারে পরিণত হয় শিশুরা, নারীরা, বৃদ্ধরা—যারা যুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো অবস্থান নেন না, কিন্তু ভোগেন সবটুকু কষ্ট।
মানবসভ্যতার ইতিহাস যুদ্ধের ইতিহাস। ট্রয়ের যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইউক্রেন, রোহিঙ্গা কিংবা গাজা—সব জায়গাতেই যুদ্ধ আমাদের দেখিয়েছে কেমন ভয়াবহ হতে পারে মানুষের লোভ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পরে সারা বিশ্বে শান্তির আহ্বান উঠেছিল। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রত্যাশা নিয়ে যে, ভবিষ্যতে যুদ্ধ রোধ করা যাবে। কিন্তু, আমরা কি সত্যিই তা করতে পেরেছি? বর্তমানে বিশ্বের নানা প্রান্তে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং উত্তেজনা, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—আমরা এখনও সেই ‘মানবতা’ শব্দটির অর্থ ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। গাজায় প্রতিদিন শিশু, নারী, আবাল, বৃদ্ধ  মানুষকে ইসরায়েল আগ্রাসী বাহিনী হত্যা করছে। জাতিসংঘ এই গণহত্যার বিরুদ্ধে  কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
তাহলে কি জাতিসংঘ থাকার প্রয়োজন আছে?
আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব (১৯৮০-র দশক থেকে), সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ (১৯৯১), বিশ্বব্যাপী নৈতিক পতনশীলতা, যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের নেতৃত্বে পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন, মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক আক্রমণ ও তার প্রতিক্রিয়া  ইত্যাদির মধ্যে দুনিয়াব্যাপী মানুষ ও তার পরিবেশ বদলে গেছে। বৃহৎশক্তিবর্গের ( জি-সেভেন, ন্যাটো) অভিপ্রায় অনুযায়ী বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা পুনর্গঠিত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি  ও শ্রমশক্তির কল্যাণে মানবজাতির উৎপাদন ও বৈষয়িক সম্পদ বেড়ে চলেছে। কিন্তু উৎপাদনশীল শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের জীবন দুর্গত। ধনসম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে অল্পকিছু লোকের হাতে। ন্যায় কমেছে, অন্যায় ও অসম্মান বেড়েছে এবং বাড়ছে। বৃহৎশক্তিবর্গের নীতি বিশ্বগ্রাসী, যুদ্ধবাদী,  সভ্যতাবিরোধী ও প্রগতিবিরোধী।
মধ্যপ্রাচ্যে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক বাহিনী ও ন্যাটো বাহিনীর আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিয়েছে জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদ দমন করা হচ্ছে কেবল আয়োজন দিয়ে। তাতে সমস্যার অবসান ঘটছে না। ওয়াশিংটনের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী প্রতিবাদ আছে; কিন্তু উন্নততর নতুন কোনো বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার সদর্থক চিন্তা নেই। 
বিশ্বায়নের কার্যক্রম দ্বারা যে বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে তা প্রমাণ করেছে,  বিশ্বায়ন সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর। বিশ্বায়নের কার্যক্রম দ্বারা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় সত্তা ধ্বংস করা হচ্ছে এবং দুনিয়াব্যাপী মানুষকে বঞ্চনার মধ্যে ফেলে মানুষের মানবিক গুণাবলি বিনষ্ট করা হচ্ছে। বিশ্বায়নের কর্তৃপক্ষ হল বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থতহবিল, জি-সেভেন, ন্যাটো, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘ। বিশ্বায়নের কর্মনীতি নিয়ে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদকে বানচাল করা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে জনগণের কাছে অর্থহীন করে পুরাতন সংস্কার বিশ্বাস ও ধর্মকে জাগিয়ে তুলেছে। সর্বজনীন কল্যাণে  জাতিসংঘ বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।   যুদ্ধ শুধু মানুষকে হত্যা করে না, যুদ্ধ ধ্বংস করে একটি জাতির স্বপ্ন, সংস্কৃতি, সভ্যতা। যুদ্ধ মানেই শিশুদের শিক্ষাজীবনের ইতি, মা-বাবাহীন ভবিষ্যত প্রজন্ম, নারীদের ওপর সহিংসতা, আর শরণার্থী হয়ে পথে পথে ঘোরা লক্ষ মানুষ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ শরণার্থী। বাংলাদেশেও প্রায় ১৫ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এদের বেশিরভাগই যুদ্ধ বা সহিংসতা থেকে পালিয়ে এসেছে। তারা তাদের ঘর হারিয়েছে, পরিচয় হারিয়েছে, ভবিষ্যত হারিয়েছে। আমরা যদি একটু ভাবি—এই শিশুগুলো যদি শিক্ষা পেত, নিরাপদ পরিবেশ পেত, তাহলে হয়তো আজকের পৃথিবী আরও অনেকটা সুন্দর হতো।
যুদ্ধে বিজয় বলে কিছু নেই—কারণ দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক পক্ষ হয়তো সাময়িকভাবে জয়ী হয়, কিন্তু হারায় হাজারো জীবন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার এবং আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা। আর পরাজিত পক্ষের অবস্থা তো আরও করুণ—দীর্ঘমেয়াদে তাদের ঘুরে দাঁড়ানো হয়ে পড়ে অসম্ভব। শান্তির পথ কঠিন হতে পারে, কিন্তু সেটিই টেকসই এবং মানবিক পথ। যে যুদ্ধের বদলে আলোচনার পথ বেছে নেয়, শক্তির বদলে সংলাপে বিশ্বাস রাখে, সেই সত্যিকারের একজন নেতা।
যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মানবিক শিক্ষা। আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অহিংসা, সম্প্রীতি, সহানুভূতি, সহনশীলতা, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিতে পারি, তাহলে একটি যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শান্তি শিক্ষা, সম্প্রীতিময় সহাবস্থানের চর্চা, বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয়গুলো আরও বেশি গুরুত্ব পেতে হবে। শুধু প্রযুক্তি নয়, মানবতা নিয়েও মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একজন কবি, লেখক বা সাংবাদিক তাঁর কলম দিয়ে যুদ্ধের বিপরীতে শক্তিশালী বার্তা দিতে পারে। আমাদের প্রয়োজন সেই কলম, যেটা তরবারির চেয়েও ধারালো হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে সেই   সৎ নির্ভীক সাহসীক নির্লোভ বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক বাংলাদেশে নেই। দেশে আজ  রাজনীতি নেই। রাজনীতি আজ শুন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা। তাদের স্বার্থ  হাসিল করার জন্য দেশে রাজনীতির পরিবেশ অস্থিতিশীল করা হয়েছে। দেশে প্রয়োজন সুস্থ ধারার নতুন রাজনীতি ও উন্নত চরিত্রের নতুন নেতৃত্ব। 
আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করি, সেটি আমাদের একটাই। এই পৃথিবী রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই। এই পৃথিবী যেন না হয় ধ্বংসের, বরং হোক ভালোবাসা আর মানবতার আশ্রয়স্থল। আমরা চাই, কোনো মা যেন তার সন্তানকে হারানোর কান্না না কাঁদে; কোনো শিশু যেন মরুভূমিতে খালি পেটে ঘুরে না বেড়ায়; কোনো বাড়ি যেন আর বোমায় গুঁড়িয়ে না যায়।
আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা চাই না গাজায়, ইউক্রেনে, সুদানে কিংবা আর কোথাও আর একটি শিশুও মারা যাক। আমাদের স্বপ্ন, এমন একটি পৃথিবী, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিরাপদ, প্রতিটি শিশুর মুখে হাসি, প্রতিটি নাগরিকের মনে শান্তি।
যুদ্ধ নয়, শান্তিই হোক আমাদের অস্ত্র। হানাহানি নয়, আলোচনাই হোক শান্তির পথ। আমরা চাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন একটি যুদ্ধমুক্ত, মানবিক, সভ্য ও সুন্দর পৃথিবীতে বেড়ে উঠতে পারে।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শুধু রাষ্ট্র বা রাজনীতিবিদ নয়, প্রতিটি নাগরিককে হতে হবে সচেতন, দায়িত্বশীল ও মানবিক। আসুন, আমরা সর্বজনীন কল্যাণে সবাই মিলে বলি-'আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই-যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী চাই।'

লেখকঃ রাজনীতিবীদ 


এ জাতীয় আরো খবর