২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস।২০১৭ সাল থেকে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।প্রতিবছর দিবসটি উপলক্ষ্যে একটি প্রতিপাদ্য থাকে।এবারের প্রতিপাদ্য-‘ মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি-কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’।সময়ের প্রয়োজনে প্রতিপাদ্যটি যথার্থই হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬০টিরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, আর বছরে প্রাণ হারান কয়েক হাজার মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে-দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, এই দুর্ঘটনার প্রায় ৭৫ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য ছিল-যদি আমরা একটু বেশি সচেতন হতাম,একটু বেশি নিয়ম মানতাম।
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই অদক্ষতার শিকার। রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন আনুমানিক গড়ে ৩০ লাখ যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু এর ৪০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন বা লাইসেন্সহীন। একই চিত্র দেখা যায় জেলা ও উপজেলা সড়কগুলোতেও। মহাসড়কে হাইস্পিড বাস, ট্রাক আর বাইকের প্রতিযোগিতা যেন অলিখিত ‘মৃত্যু রেস’। চালকের অদক্ষতা, মাত্রাতিরিক্ত গতি, যত্রতত্র ওভারটেকিং-সব মিলে সড়ককে করে তুলেছে ভয়াবহ।
বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো-অব্যবস্থাপনা। নতুন সড়ক নির্মাণ, সেতু, ফ্লাইওভার-সব কিছুতেই রয়েছে নির্মাণ ত্রুটি, দুর্নীতি ও তদারকির অভাব। সড়ক নির্মাণে গুণগতমান নিশ্চিত না হওয়ায় অল্পতেই গর্ত, ফাটল বা ধস নামে। সড়কে নেই সঠিক সাইনেজ, নেই রোড মার্কিং, নেই নিয়ন্ত্রিত জেব্রা ক্রসিং বা ইউটার্ন।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও হাইওয়ে পুলিশের মধ্যে দায়িত্বের সুষ্পষ্ট বিভাজন না থাকায় আইনের প্রয়োগ দুর্বল। অনেকে ঘুষ দিয়ে ফিটনেস ছাড়পত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিচ্ছেন-যা একটি বড় অনিয়মের চক্র। চালকের দক্ষতা যাচাই না করে কেবল ফরমাল পদ্ধতিতে অনুমোদন দেওয়া সড়ক নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অবশ্য চালকদের দোষই সব নয়। দিনের পর দিন ১৬–১৮ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। বিশ্রাম নেই, স্বাস্থ্যপরীক্ষা নেই, মনিটরিং নেই। মালিকদের চাপ, অপ্রতুল মজুরি, প্রতিযোগিতা-সব মিলিয়ে চালকরা প্রায় এক মানববোমার মতো সড়কে নামেন। একটি ভুল সিদ্ধান্তেই ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়।
তাছাড়া, চালকদের প্রশিক্ষণের মান, লাইসেন্স পদ্ধতির স্বচ্ছতা এবং স্বাস্থ্যগত যোগ্যতা পরীক্ষার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরিশালের একটি দুর্ঘটনায় চালকের পা অবশ ছিল বলে প্রমাণ মেলে। অথচ তার লাইসেন্স ছিল বৈধ। প্রশ্ন হলো-কে যাচাই করল তার শারীরিক সক্ষমতা?
অপরদিকে, যাত্রীরাও অনেক সময় নিজেরাই নিজের বিপদের কারণ হন। হেলমেট না পরা, রাস্তা পারাপারে নিয়ম না মানা, চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দেওয়া, বাসে ওঠা-নামার সময় অসতর্কতা-এসবকিছুই দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা কম, দায়সারা মনোভাব বেশি। স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রম এখনও পর্যাপ্ত নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক নিরাপত্তায় প্রযুক্তি ব্যবহারের দাবি উঠেছে জোরালোভাবে। ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে সিসিটিভি, স্পিড ক্যামেরা, জিপিএস ট্র্যাকিং-এই ব্যবস্থা চালু হলেও তা খুবই সীমিত। বিআরটিএ-এর ডিজিটাল লাইসেন্স যাচাই ব্যবস্থা বা যানবাহনের ডাটাবেইজ এখনও ত্রুটিপূর্ণ ও অপর্যাপ্ত। অনলাইন জরিমানা ব্যবস্থা বা অটোমেটেড ট্রাফিক আইন প্রয়োগ এখনো বিস্তৃত হয়নি।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে বাস্তবভিত্তিক কিছু প্রস্তাবনাঃ
১) চালকের দক্ষতা যাচাই ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বছরে একবার মেডিকেল টেস্ট বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
২) সড়কের ডিজাইন ও নির্মাণে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি নতুন প্রকল্পে ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও সেফটি অডিট বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩) ট্রাফিক আইন অটোমেটেড পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে-স্পিড ক্যামেরা, ট্রাফিক সেন্সর, জিপিএস মনিটরিং চালু করে।
৪) জনসচেতনতা বাড়াতে স্কুল-কলেজে ট্রাফিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সড়ক নিরাপত্তা ক্লাব’ গঠনের নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।
৫) নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া চালু করা জরুরি। প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় তদন্ত ও ট্রাইব্যুনাল কার্যকর করতে হবে।
৬) বিআরটিএ-তে দুর্নীতি বন্ধে ডিজিটালাইজেশন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
৭) বিকল্প গণপরিবহন ব্যবস্থা যেমন মেট্রোরেল, লাইট রেল, এবং ওয়াকেবল ও বাইকেবল শহর গড়তে সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা কোনো দৈব ঘটনা নয়-এটি আমাদের দীর্ঘদিনের অবহেলা, ব্যর্থতা ও অসচেতনতার ফসল। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে দায় আছে রাষ্ট্রের, সমাজের, পরিবারের এবং ব্যক্তির। নিরাপদ সড়ক একটি মানবাধিকার। এটি শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং নাগরিকদেরও একটি নৈতিক দায়িত্ব।
সড়ক শুধু চলাচলের পথ নয়-এটা জীবনের রক্তধারা।অফিসগামী মানুষ,স্কুলের শিশু,শ্রমজীবী কর্মী-সবাই এই রাস্তায় মিলেমিশে চলে। কিন্তু যখন একজন চালক অতিরিক্ত গতি তোলে,যখন পথচারী জেব্রা ক্রসিং উপেক্ষা করে, তখন সেই মুহূর্তেই সড়ক রূপ নেয় বিপদের মাঠে।
সড়ক নিরাপত্তা মানে শুধু ট্রাফিক আইন নয়-এটা মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন।একজন সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব হলো নিজের নিরাপত্তার পাশাপাশি অন্যের নিরাপত্তাকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া।
আজকের তরুণ প্রজন্ম ডিজিটাল,স্মার্ট,উদ্ভাবনী-তাদেরই হাতে নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা।প্রযুক্তি এখন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে, রুট ব্যবস্থাপনায়, এমনকি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।স্মার্ট সিগন্যাল,ডিজিটাল ট্র্যাকিং,ড্যাশক্যাম ও রাইডশেয়ারিং অ্যাপ-সবকিছুই আমাদের এক ধাপ এগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রযুক্তির চেয়ে বড় শক্তি হলো মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন।আমরা যদি মনে রাখি, ‘একটি ভুল সিদ্ধান্ত মানে একটি পরিবারের শোক’-তাহলে পরিবর্তন সম্ভব।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন শুধু দাবির নাম নয়-এটা এক চেতনার নাম।তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সংগঠনটি দেশের প্রতিটি প্রান্তে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,পরিবহন খাত,সরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম ও সাধারণ নাগরিক-সব সেক্টরকে এক সূত্রে বাঁধছে একটি লক্ষ্য নিয়ে: প্রত্যেক মানুষ যেন নিরাপদে ঘরে ফেরে।
আমরা যখন রাস্তায় নামি, তখন একটি ছোট পদক্ষেপও জীবন বাঁচাতে পারে।
-হেলমেট পরা মানে নিজের মায়ের চোখের জল বাঁচানো।
-সিটবেল্ট বাঁধা মানে সন্তানের হাসি রক্ষা করা।
-ট্রাফিক সিগন্যাল মানা মানে সমাজের প্রতি সম্মান দেখানো।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট সড়ক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।কারণ উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয়,যখন সে উন্নয়নের পথে মানুষ নিরাপদ থাকে।
তাই আজই আমরা সবাই একসাথে বলি-‘আমি নিয়ম মানি, আমি জীবন ভালোবাসি-আমি নিরাপদ সড়কের নাগরিক।‘
‘নিরাপদ সড়ক চাইশুধু একটি শ্লোগান নয়-এটি এখন বেঁচে থাকার শর্ত।
লেখকঃ কলামিস্ট,সোস্যাল এক্টিভিস্ট,মহাসচিব-নিরাপদ সড়ক চাই।