বুধবার, অক্টোবর ২২, ২০২৫

নিরাপদ সড়কের প্রয়োজনীয়তা

  • লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল
  • ২০২৫-১০-২১ ১৯:৩৪:১০

টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরাপদ সড়কের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। দেশে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এখনো দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি।
২২ অক্টোবর ২০১৭ সাল থেকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে সরকারি উদ্যোগে জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। প্রতিবছর সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ও বিভিন্ন সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি পালন করে থাকে। এ বছর ২২ অক্টোবর (বুধবার) নবমবারের মতো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, চালকদের অদক্ষতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট ব্যবহার না করা। ওভারটেকিং করার প্রবল মানসিকতা, ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন না মানা ইত্যাদি। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে, অনেক সড়ক-মহাসড়ক পরিকল্পনাহীনভাবে নির্মাণ, নির্দিষ্ট লেন ধরে গাড়ি না চালিয়ে সড়কের মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, রাস্তায় বিপজ্জনক বাঁক বিদ্যমান থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, মাদকসেবন করে গাড়ি চালানো, ভুল পথে গাড়ি চালানো, রাস্তায় চলাচলকারী যাত্রী বা পথচারীদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, ফুটপাত ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে পথচারীদের চলাচল, রাস্তা পারাপারের জন্য ওভারব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার না করা, রাস্তার উপর বা ফুটপাতে দোকানপাট সাজিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিকব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রাস্তায় চলাচলে বিদ্যমান নিয়ম-কানুন প্রতিপালনে যাত্রীদের অনীহা।
দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, তাতে সড়ক মহাসড়কগুলো দিন দিন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে এখন চলাচল করা মানেই নিজের জীবনবাজি রেখে চলাচল করা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) মতে গত দুই দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৯৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ গত ২০ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ কমাতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত রোগীদের পেছনে ব্যয় হয়। সড়ক নিরাপদ করা গেলে স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের ওপর চাপ কমবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত হলে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কমবে। ফলে হাসপাতালে রোগীদের সেবার মানও বাড়ানো সম্ভব হবে।
এআরআই জানিয়েছে ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য চালকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। দেশের সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) দুই থেকে তিন শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। সড়ক দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি ও দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট যানজট দেশের অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার পদক্ষেপ নিলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বহীনতার অভাব এর কারণে এক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কগুলোতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং চালকদের দক্ষতা বাড়াতে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও সচেতনতার ওপর জোর দিতে হবে। গতি নিয়ন্ত্রণ, গতি পর্যবেক্ষণের আধুনিক স্পিড ক্যামেরা স্থাপন, মহাসড়কে নজরদারির জন্যে স্থায়ী লোকবল নিয়োগ এবং দুর্ঘটনার পর তৎক্ষণিক উদ্ধার ও সেবাদানের জন্য ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে শুধু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে তা কিন্তু নয়। একইসঙ্গে মানুষের শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংগত কারণে এ সমস্যা সমাধানে সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সড়ক দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের বিনাশ সবচেয়ে বড় ক্ষতি। দুর্ঘটনাকবলিত একটি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে অমানবিক কষ্ট ভোগ করে থাকে। তাদের এ ক্ষতি অপূরণীয়। অনেক ক্ষেত্রেই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। আর যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এরূপ দুর্ঘটনায় শিকার হয়, তাহলে এর প্রভাব হয় আরো দীর্ঘমেয়াদি। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে পরিবহন খাতের অবদান অনস্বীকার্য। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি বলা যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, পরিবহন খাতের নিরাপত্তা আজও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারসহ সবাইকে সর্বাধিক সচেষ্ট থাকতে হবে।
দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা যদি অতি দ্রুত রোধ করার ব্যাপারে বাস্তবমুখী ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় বা এ ব্যাপারে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা না হয়, তাহলে আগামীতে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
এটা সত্য, আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক নাজুক। একদিকে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া! অন্যদিকে অদক্ষ চালককে গাড়ি চালানোর সুযোগ করে দিয়ে যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে প্রতিপালন না করে এবং ফিটনেসহীন গাড়ি চালাতে দিয়ে সড়কের মড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কোনো অসম্ভব কাজ নয়। এজন্য দরকার সরকার ও জনগণের ইতিবাচক চিন্তা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার যথোপযুক্ত বাস্তবায়ন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বাগ্রে চালকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম অনেকাংশে টেনে ধরা সম্ভব হবে। এছাড়া ট্রাফিক আইন সম্পর্কে চালকসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তায় নিরাপদে চলাচলের লক্ষ্যে প্রণীত আইন-কানুন যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। মাদকসেবন করে যাতে চালকরা গাড়ি চালাতে না পারে, সেজন্য নিয়মিত বিরতিতে চালকদের ডোপ টেস্ট করতে হবে। গাড়ি চালানো অবস্থায় চালকদের মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নিয়ন্ত্রিত বা নিরাপদ গতি সড়কে চলাচলরত যানবাহন ও যাত্রীদের নিরাপত্তা অনেককাংশে নিশ্চিত করতে। সেই সাথে মোটরসাইকেল আরোহীগণ মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে।
চালকদের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাস্তায় প্রয়োজনীয় গতি পরিমাপক যন্ত্র স্থাপন করতে হবে। দুর্ঘটনা রোধে চালকদের ওভারটেকিং করার মানসিকতাও পরিহার করা জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের সড়কব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। শুধু চালকদের দক্ষতা বিচার করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি না ঘটে, সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থেকে নিশ্চিত করা আবশ্যক। সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা না করে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং নিরপেক্ষভাবে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা যেভাবেই হোক দ্রুত দূর করতে হবে।
দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিকে আরো বেগবান করতে এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরাপদ সড়কের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সবার সদিচ্ছা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

 লেখক পরিচিতিঃ
শিক্ষক, কবি, কলাম লেখক, সমাজসেবক ও সংগঠক
যুগ্মমহাসচিব, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কেন্দ্রীয় কমিটি


এ জাতীয় আরো খবর