এম পক্স একটি ভাইরাল অসুস্থতা যা মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। মাঙ্কিপক্স ভাইরাস প্রথমে পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় কিম্তু বর্তমানে মানুষ থেকে মানুষেও এর সংক্রমন ঘটছে। আমরা অনেকেই এ রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিনা। সারা বিশ্বে বিশেষ করে আফ্রিকাতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হা ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য জরুরি অবস্হা ঘোষনা করেছে। এম পক্স জলবসন্ত বা গুটিবসন্তের ভাইরাস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫৮ সালে বানরদের মধ্যে পক্সের মত একটি রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দিলে বিজ্ঞানীরা এই রোগ সনাক্ত করেন।
২০২২ সালের জুলাইয়ে এম পক্সের মৃদু ক্লেড ২ ধরন প্রায় ১০০ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে ছিল এশিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশও। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এম পক্স ভাইরাসের রুপ বদল হয়।পরিবর্তিত এই নতুন ধরনের নাম ক্লেড-বি ১।বিজ্ঞানীরা এটিকে সবচেয়ে বিপজ্জনক আখ্যায়িত করেছেন।
এম পক্সের প্রাথমিক উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জ্বর,মাথা ব্যথা, ঘাম, মাংস পেশিতে ব্যথা এবং পিঠে ব্যথা। জ্বর সেরে গেলে ফুসকুড়ি দেখা যায়। সাধারনত মুখমন্ডলে শুরু হয় এবং ক্রমে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে। ফুসকুড়িগুলোতে ভীষন চুলকানিসহ ব্যথা হতে পারে। পরে এগুলো শুকিয়ে যায় এবং খোস পাঁচড়াার রুপ ধারন করে। তিন সপ্তাহের দিকে এগুলো শুকিয়ে যায় এবং শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি করে। ক্ষতগুলো মুখ চোখ এবং যৌনাঙ্গে দীর্ঘ সময় থেকে যেতে পারে।
বন্য পশু ছাড়াও এম পক্সে সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। শারীরিক সম্পর্ক, শ্বাস প্রশ্বাস, ত্বকের সংস্পর্শ, খুব কাছাকাছি অবস্থান করা ইত্যাদির মাধ্যমে এম পক্স ছড়ায়।ভাইরাসটি শরীরের কাটা ছেঁড়া অংশ, চোখ,নাক,মুখ, নিশ্বাস ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত বিছানা, তোয়ালে বা জামা কাপড়ের মাধ্যমেও ছড়ায় এই রোগ।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে ২০২২ সালে ব্যাপকভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ছিল অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক।
স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরা অধিক ঝুঁকিতে থাকেন এই রোগ সংক্রমনের।
আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে এম পক্সে সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।মাক্স ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে। পোষা বা বন্য প্রানী হতে দুরে থাকতে হবে। মাংস ভাল করে ধুয়ে পরিপূর্ণ সেদ্ধ করে খেতে হবে। গর্ভবতী মা এই রোগে আক্রান্ত হলে তার গর্ভের সন্তানের মাঝেও এই রোগ ছড়াবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যথার্থ স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে। এম পক্সের শুকিয়ে যাওয়া ফুসকুড়িও সংক্রামক। তাই পরিপূর্ণ সুস্হ না হওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাবধানতার সাথে আইসোলেটেড থাকতে হবে।
আফ্রিকার বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলোতে প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং কয়েকশত মৃত্যু বরণ করে। শিশু এবং বয়েসীদের ক্ষেত্রে এই রোগটি অধিকতর জটিলতা সৃষ্টি করে এবং অধিক প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এম পক্সের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। জ্বর, মাথা ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ সেবন করা যেতে পারে। প্রচুর পানি ও পানীয় সহ তাজা ফল বা ফলের রস খেতে হতে। এই অসুখে প্রচুর প্রোটিন ক্ষয় হয় তাই প্রোটিন জাতীয় খাবারকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিশ্রামে থাকতে হবে। মানসিক প্রশান্তি ধরে রাখতে হবে। কোনরকম জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।স্বাস্হ্য সচেনতা রাখতে হবে প্রাত্যাহিক চর্চায়।এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যবসেবামূলক
প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ভূমিকায় অটল থাকতে হবে।এম পক্স যাতে কোনভাবেই মহামারির আকার ধারন করতে না পারে সে জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হা সহ বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকে তার করণীয় সব কিছুই যথার্থ রুপে করতে হবে।
কোন বিপর্যয়ই স্হায়ী নয়। যত বড় আঘাতই হানুক না কেন একসময় হেরে যাবে,থেমে যাবে এম পক্স। মাঝের এই সময়টুকু নিশ্চয়ই ধৈর্য্য, সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবায় নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সচেষ্ট থাকব।আমরা সবাই। রোগ মুক্ত আগামী ভোরের নতুন সূর্যোদয়ে উদ্ভাসিত দিনগুলো আমাদেরই হবে।
লেখক ঃ
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক চিকিৎসক
কবি ও কথাসাহিত্যিক, গবেষক, কলামিস্ট ও গিটারিস্ট।