বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ১৩, ২০২৫

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ ও একজন সেলিম মোরশেদ

  • ইশরাত তানিয়া
  • ২০২৫-০১-৩০ ২৩:৫৪:৫৯

‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’ প্রস্তাবক কমিটির প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে এবং পুরস্কার কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেলিম মোরশেদ কথাসাহিত্যে পুরস্কারপ্রাপ্ত হন। আনুষ্ঠানিকভাবে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ পুরস্কার গ্রহণ করার কথা।    
এবার পুরস্কারপ্রাপ্তদের নামের তালিকা দেখে এদেশের সাহিত্যজগত আন্তরিকভাবে প্রশংসা করে। আর করবে না-ই বা কেনো?  রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকারের আমলে দলীয় আনুগত্যের বাইরে যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন কবি-লেখকের নাম আসা প্রায় অসম্ভব। সবাই আশাবাদী হয়ে উঠলো সাহিত্যে এবার মেধা আর প্রতিভার জয় দেখে। জুলাই ২৪ই এই অসাধ্য সাধন করলো। এই তো জুলাইয়ের স্পিরিট! হঠাৎই অনভিপ্রেত কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায় পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা স্থগিত করা হলো।
আত্মমর্যাদাবোধ এবং প্রস্তাবক কমিটির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সেলিম মোরশেদ সবিনয়ে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং প্রেক্ষিত বিষয়ে বিস্তারিত লিখলেন। তিনি দলীয় রাজনীতির ছাপবিহীন এই পুরস্কার পেয়ে খুশি হয়েছিলেন। আমরা লেখকরা লক্ষ্য করলাম এই প্রথম লিটলম্যাগ ঘরানার সাহিত্যিককে বাংলা একাডেমি কথাসাহিত্যে পুরস্কৃত করলো— এমন একজন মানুষকে যিনি মাথা উঁচু করে সাহিত্যচর্চাই করে গেছেন। সেলিম মোরশেদকে পুরস্কৃত হতে দেখে সবাই আনন্দিত। পাঠক, সহলেখক, সম্পাদক, প্রকাশক, পরিবার ও স্বজনদের উচ্ছ্বাস তাঁকেও ছুঁয়ে গেছে। তিনি সে কথা জানিয়েছেন প্রত্যাখ্যানপত্রে। স্পষ্ট করে বলেছেন— “...যখন পুরস্কারের তালিকা স্থগিত করা হলো তখন আমার কাছে এটা আর সম্মানজনক থাকলো না। না, ছোটোকাগজ আন্দোলন কিংবা প্রতিষ্ঠান-অপ্রতিষ্ঠানের জন্য না। এর কারণ, আমি দেখে ফেললাম কিছু অ-লেখক এবং লোভী-লেখকের ইন্ধন এবং তৎপরতা। যারা আমার সম্মান নিয়ে খেলা করার ক্ষমতা রাখে না। ...কোনো রাজনৈতিক চাপ কিংবা পাঠক-সন্তুষ্টির জায়গা থেকে এখন এই পুরস্কার থেকে সরে আসছি না। প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে আমার নিজের জন্য।” 
সেলিম মোরশেদ প্রস্তাবক কমিটির সাংস্কৃতিক উচ্চতা আর সাহিত্যবোধের প্রশংসা করে বলেছেন স্থগিতাদেশের মাধ্যমে তাঁদেরও অসম্মান করা হয়েছে। কিছুটা হলেও তাঁদের হারানো সম্মান তিনি ফিরিয়ে দিচ্ছেন পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে। প্রত্যাখ্যানপত্র প্রকাশের পর আপনারা অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের ধন্যবাদ জানাই সহমর্মিতার জন্য। কিন্তু সে বিষয় নিয়ে এই লেখা না। 
লিখছি কিছু বোধহীনের জিজ্ঞাসা আর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে। তাদের প্রশ্নগুলো মোটামুটি এমন— পুরস্কারের তালিকা স্থগিত করেছে, এ অবস্থায় প্রত্যাখ্যান করেন কিভাবে? প্রত্যাখ্যানের দরকার কী? দ্বিতীয়বারের তালিকায় কি নাম আসবে? নাম এলে কি প্রত্যাখ্যান করবেন? নাকি দ্বিতীয়বার যদি নাম না আসে সেটা ভেবে আগেই প্রত্যাখ্যান করেছেন?  
সেই প্রেক্ষিতেই কিছু কথা বলা। বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী একজন কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ জানেন তালিকা স্থগিত মানে বাতিল করা না। তিনি জানতেন মূলত স্থগিত করা হয়েছে তালিকাভুক্ত দুজনকে নিয়ে। এদের মধ্যে তাঁর নাম নেই। আমরাও বুঝতে পারছিলাম তিনি যোগ্য এবং রাজনৈতিক দর্শনের  জায়গা থেকেও (যেহেতু স্থগিতাদেশে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে) তিনি ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী যা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত। কিন্তু তিনি পুনঃনির্বাচিত হবার সমস্ত সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়ে। শুধুই তাঁর ব্যক্তিগত সম্মানবোধ আর প্রস্তাবক কমিটির মর্যাদার প্রশ্নে। 
আমি যখন টেলিফোনে সেলিম মোরশেদকে জানালাম যে, প্রত্যাখ্যানপত্র দেয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য (সঙ্গত কারনেই তাঁদের নাম উল্লেখ করছি না) তিনি আমাকে একটা কথাই বললেন— “বিপ্লবী হওয়ায় জন্য আমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করিনি।”   
সেলিম মোরশেদ গভীর চিন্তার মানুষ। তিনি জানতেন তথাকথিত পুনর্বিবেচনার তালিকাতেও তাঁর নাম থাকবে। তাই এই প্রত্যাখ্যানপত্র। আমি তাঁর স্ত্রী শুধু নই, একজন সাহিত্যিকও। আমি জানি, সেলিম মোরশেদের নাম তেমনভাবে কোথাও আসে না। কিন্তু একবার যদি এসে যায় সেটা আর মোছা যায় না, যদি না তিনি সেখান থেকে নিজে সরে দাঁড়ান। আমার সাহিত্যিক সত্তা থেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— এই প্রত্যাখ্যান পুনর্বিবেচনা করা যায় কি না? তিনি যদি একাডেমি থেকে অনুরুদ্ধ হন তবে কি পুরস্কার গ্রহণ করবেন? শান্ত গলায় বললেন— না। 
এ প্রসঙ্গে আমার আর কিছু বলার নেই। আপনারা কোনো পক্ষই অনুগ্রহ করে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আমরা বরং অপেক্ষা করি। দেখি কী সিদ্ধান্ত আসে। 
সেলিম মোরশেদ নিজেকে সরাতে জানেন, হারিয়ে ফেলতে জানেন— মানুষ তো তাঁকে খুঁজবেই।


এ জাতীয় আরো খবর