প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) আজ এক সংবাদ সম্মেলনে পোল্ট্রি খাতে বিদ্যমান সিন্ডিকেট ও অরাজকতার বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হল-
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বন্ধুগণ, আসসালামু আলাইকুম।
আপনারা জানেন, বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন হিসেবে আমরা সর্বদা তাদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের প্রতিবাদ কখনোই কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানির বিরুদ্ধে নয়, বরং পোল্ট্রি খাতের সুষ্ঠু বিকাশ, প্রান্তিক খামারি, ভোক্তা এবং দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য। পোল্ট্রি খাতে বিদ্যমান সিন্ডিকেট ও অরাজকতার বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য কেবলমাত্র খাতের সমস্যা চিহ্নিত করা এবং এর সমাধান খোঁজা। আমরা কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ বা শত্রুতা করছি না, বরং সবার কল্যাণে একটি উন্নত ও ন্যায্য পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তাহলে কেন আমাদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা এবং প্রাণনাশের হুমকি থাকবে? আমাদের বিশ্বাস, এই চেষ্টা পোল্ট্রি শিল্পের সুষ্ঠু উন্নয়ন এবং দেশের পোল্ট্রি খাতের সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে।গত তিন থেকে চার বছর ধরে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে একের পর এক সংকট চলছে।
ক্ষুদ্র খামারিদের রক্ষা করতে হবে—কে দেবে তাদের ন্যায্য মূল্য?দেশজুড়ে মুরগির দাম ২০ টাকা বাড়লেই হইচই পড়ে যায়, অথচ বাচ্চার দাম ১০০ টাকা বেড়ে গেলেও কেউ কথা বলে না! এই যে সিন্ডিকেট ক্ষুদ্র খামারিদের রক্ত চুষে নিচ্ছে, এটা নিয়ে কোথাও তেমন কোনো আলোচনাই নেই।গত দুই মাসে দেশের ৯০% খামারি লস দিয়েছে। সবাই আশা করেছিল, ঈদে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবে, কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীর কারণে সেই আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।রমজান মাসে ডিম ও মুরগির দামে কিছুটা স্বস্তি থাকবে, কারণ উৎপাদন খরচ কম এবং বাজারের চাহিদা সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে। তবে ঈদের সময় মুরগির দাম বাড়বে, কারণ ঈদের জন্য যে মুরগি বাজারে আসবে, তার উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হবে। মূলত, কোম্পানিগুলো আগেই মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করেছে এবং এই কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, ঈদে ভোক্তার চাহিদাও বাড়বে, যার ফলে বাজারে মুরগির সংকট সৃষ্টি হবে এবং মৌসুমীভাবে দাম আরও বাড়বে। এই দাম বৃদ্ধির পিছনে একমাত্র দায়ী হচ্ছে মুরগির বাচ্চার সিন্ডিকেট, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সংকট তৈরি করে এবং বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
বিশেষ করে ডিম এবং মুরগির বাজার সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। এই অস্থিরতার মূল কারণ হলো একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যারা ফিড এবং মুরগির বাচ্চার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন, প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন হিসেবে, আমরা প্রতিনিয়ত খামারিদের স্বার্থ রক্ষা এবং ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করছি। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ৫০-৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বজায় রাখা এবং পোল্ট্রি শিল্পের সুষ্ঠু উন্নতি নিশ্চিত করা।কিন্তু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলি কার্যকর না হওয়ার কারণে বড় কর্পোরেট হাউজগুলো আমাদের মতো ছোট উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তবে আমরা সব প্রান্তিক খামারি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যাব।
প্রান্তিক খামারির জন্য সরকারের নির্ধারিত দাম কখনোই বাস্তবে কার্যকর হয়নি। কৃষি বিপণন ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী, এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৭০ টাকা, একটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা এবং এক কেজি সোনালি মুরগির দাম ২৬০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও, খামারিরা এই দামে কখনোই পণ্য বিক্রি করতে পারেননি। বাজারে অস্থিরতা শুরু হলে অল্প সময়ের জন্য কিছুটা দামে বিক্রি হলেও তা স্থায়ী হয়নি। বাস্তবে, খামারিদের উৎপাদিত মুরগি ও ডিমের দাম ২০০-২২০ টাকা ও ১২-১৩ টাকা পর্যন্ত চলে যায়। সরকার যদি প্রান্তিক খামারিদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত না করতে পারে, তবে বাজারের অস্থিরতা থামানো সম্ভব নয়। সরকারের উচিত, খামারিদের স্বার্থ রক্ষা করে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
পোল্ট্রি খাতের সিন্ডিকেট কারা? সরকার কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? ব্রিডার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ এবং ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ – এই দুই সংগঠনের ১০ থেকে ১২টি কোম্পানি পুরো পোল্ট্রি খাতকে জিম্মি করে রেখেছে। এদের নাম বারবার পত্রিকার শিরোনাম হলেও, সরকার কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? তাহলে কি তারা সরকারের থেকেও শক্তিশালী?
২০২২ সালের আগস্ট মাসে, আমরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের অপকর্ম ফাঁস করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তদন্ত করে সিন্ডিকেটের সত্যতা খুঁজে পায় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেয়। পরবর্তীতে, প্রতিযোগিতা কমিশন ৮ থেকে ১০টি পোল্ট্রি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে এবং চারটি কোম্পানিকে জরিমানা করে। সবশেষ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে আরও একটি কোম্পানিকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু এই কোম্পানিগুলো হাইকোর্টে আপিল করে মামলা স্থগিত করিয়ে নিয়েছে। ফলে, সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং তারা সামান্য জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যেতে পারে।
মুরগির বাচ্চার বাজারে কর্পোরেট সিন্ডিকেটের কারসাজি স্পষ্ট!
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ সরকার ডিম ও মুরগির দাম নির্ধারণ করতেই ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে বড় গ্রুপগুলো কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মুরগির বাচ্চার উৎপাদন কমিয়ে দেয়। পরিকল্পিতভাবে শবে বরাত, রমজান, ঈদসহ বিভিন্ন সময়ে বাজারে সংকট তৈরি করে মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ানো হয়। দেশে প্রতি মাসে ৮ কোটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদিত হয়।মুরগির বাচ্চার বাজারে সিন্ডিকেটের একাধিক স্তর কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেয়। কোম্পানির কিছু অসাধু সেলস অফিসার দুর্নীতির মাধ্যমে দাম আরও বাড়িয়ে তোলে। মুরগির বাচ্চার কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়, যার ফলে খামারিরা ৭০ থেকে ৯০ টাকা দামে বাচ্চা কিনতে বাধ্য হন, যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাচ্চার দাম ৪৯ টাকা নির্ধারণ করেছে। লেয়ার মুরগির বাচ্চার সরকার নির্ধারিত দাম ৫৭ টাকা হলেও, কোম্পানির এসএমএসের মাধ্যমে ৭০ থেকে ৮৫ টাকা এবং কখনো কখনো ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।এতে করে, প্রান্তিক খামারিরা ন্যায্য মূল্যে বাচ্চা ও ফিড কিনতে পারছেন না, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, এবং ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী ব্রিডার কোম্পানিগুলো প্রতি সপ্তাহে ২ কোটি এবং প্রতি মাসে ৮ কোটি বাচ্চা উৎপাদন করে। যদি প্রতি বাচ্চায় মাত্র ২০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হয়, তাহলে ছয় মাসে সিন্ডিকেটের পকেটে জমেছে প্রায় ৯৬০ কোটি টাকা! অন্যদিকে, প্রান্তিক খামারিরা ন্যায্য মূল্য না পেয়ে দিন দিন উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ৫০-৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।
৬ দফা দাবি-
১,প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে নীতি নির্ধারণ কমিটিতে প্রান্তিক খামারিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে, শুধুমাত্র কর্পোরেট কোম্পানিগুলোই এই মিটিংগুলোতে অংশগ্রহণ করে, যার কারণে বাজারে বারবার একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
২,বাজার মনিটরিং ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফিড ও মুরগির বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা কমিশনকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে এবং সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩,ন্যায্য মূল্যে ফিড ও বাচ্চা সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারি উদ্যোগে একটি স্বতন্ত্র পোল্ট্রি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা সরাসরি খামারিদের ফিড ও বাচ্চা ন্যায্য মূল্যে সরবরাহ করবে।
৪,কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর অপব্যবহার বন্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্পোরেট কোম্পানিগুলো কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর নামে খামারিদের শোষণ করছে, যা বন্ধ করতে হবে। খামারিদের স্বার্থ রক্ষায় একটি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করতে হবে এবং কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর জন্য বাধ্যতামূলক নীতিমালা তৈরি করে খামারিদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৫,প্রান্তিক খামারিদের সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা উচিত। ‘পোল্ট্রি উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ও ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে।
৬,পোল্ট্রি কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বড় কোম্পানিগুলোর আদালতের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোল্ট্রি খাত রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন সিন্ডিকেট যদি ভাঙা না হয়, তাহলে ভোক্তা ও খামারিরা কর্পোরেট চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের পথে যাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তাই, সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে প্রান্তিক খামারিদের সুরক্ষা দিন, ন্যায্য বাজার নিশ্চিত করুন!
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন সংগঠনের সভাপতি সুমন হাওলাদার , আরো উপস্থিত ছিলেন সহ সভাপতি বাপ্পি কুমার দে , সাধারন সম্পাদক ইলিয়াস খন্দকার, যুগ্ন সাধারন সম্পাদক মোঃ কাওছার আহমেদ, কার্যনির্বাহী সদস্য মোঃ লোকমান হোসেন সহ আরো অনেকে।
ধন্যবাদান্তে
মোঃ সুমন হাওলাদার
সভাপতি,বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশন বিপিএ