কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি :
কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানার বিরুদ্ধে মৃত এক প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে অষ্টম শ্রেণির সনদ তৈরি করে তার প্রতিষ্ঠানে চতুর্থ শ্রেণীর দুই কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রধান শিক্ষক শোকরানা বিভিন্ন সময়ে
সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বিদ্যালয় তহবিলের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট
মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বাবু প্রধান শিক্ষক শোকরানাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন।
জালিয়াতি যেভাবে শুরু:
২০০৩ সালের ১৭ জুলাই মারা যান কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার দেহুন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ মনসুর আলী। তার মৃত্যুর প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর, ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এবং আর মৃত্যুর প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর, ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি তার স্বাক্ষর দিয়ে তৈরি করা অষ্টম শ্রেণির দুটি একাডেমিক সার্টিফিকেট দিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে দুইজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়ে।
অভিযোগ উঠে ওই সার্টিফিকেটগুলো তৈরি করেন মোকারম হোসেন শোকরানা নিজে। এরপর এদেরকে নিয়োগ দিয়ে হাতিয়ে নেন কয়েক লাখ টাকা। সম্প্রতি মৃত এই প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা ভুয়া সার্টিফিকেটের বিষয়টি ধরা পড়ার পর এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দেহুন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো: আবদুছ ছালাম। তিনি জানিয়েছেন, 'বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ মনসুর আলী মারা যাওয়ার পর উনার স্বাক্ষরে যে দুটি অভিজ্ঞানপত্র তৈরি করা হয়েছে, সেটি ভুয়া ও অগ্রহণযোগ্য। এছাড়া জীবদ্দশায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে উনার স্বাক্ষরিত কাগজপত্রে দেওয়া স্বাক্ষরের সাথে এ দুটি অভিজ্ঞানপত্রের স্বাক্ষরেরও মিল নেই। তাই এটি বাতিলযোগ্য।
এ রকম পরিস্থিতিতে আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানার এ নিয়োগ জালিয়াতির বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্যা টাউন’। কেবল নিয়োগ জালিয়াতিই নয় বিদ্যালয়টির আয়-ব্যয়ের হিসাবে লাখ লাখ টাকার অসঙ্গতি, সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে মনগড়া বেতন-কাঠামোর মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত এবং অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও ওঠেছে প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানার বিরুদ্ধে। এমনকি ম্যানেজিং কমিটির কোন ধরণের অনুমোদন ছাড়াই তিনি ওমরা হজ পালনের জন্য টানা ১৪দিন দেশের বাইরে অবস্থান করেছেন। এ সময়ে বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে দায়িত্বও দিয়ে যান নি। প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় নিয়ে এবার সরব হয়েছেন খোদ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বাবু। তিনি গত ২৩ মে প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানাকে কারণ দর্শানোর একটি নোটিশ দেন। নোটিশে ৫টি কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, 'কর্তৃপক্ষ/সভাপতির পূর্বানুমতি ব্যতিত দেশ ত্যাগ করে বিগত ১৮ এপ্রিল থেকে ১মে পর্যন্ত কর্মস্থলে প্রধান শিক্ষক শোকরানা অনুপস্থিত ছিলেন, যা ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালা ২০২৪ এর ৫১(২)খ ধারার পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সংক্রান্ত নীতিমালা, ২০২৩ উপেক্ষা করে প্রধান শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় পরিচালনা করছেন, যা সরকারি বিধি পরিপন্থি। প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানা অসৎ উপায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য আয়া পদে ৩৫ উর্ধ্ব মোছা. লিপা আক্তার এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে ৩৫ উর্ধ্ব মো. খোকন কে ভুয়া/জাল শিক্ষাগত যোগ্যতার অভিজ্ঞানপত্র, নিয়োগ সংক্রান্ত ভুয়া/জাল রেকর্ড প্রদান করে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে তাদের এমপিওভুক্তির আবেদন অগ্রায়ন করে এমপিওভুক্ত করে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন বাবদ অবৈধভাবে অর্থ উত্তোলন করছেন বা করাচ্ছেন যা এমপিও নীতিমালা-২০২১ এর ১৮.১ (গ), (ঙ) ধারার এবং ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালা ২০২৪ এর ৫১(১)(ক) থেকে (চ) ধারা পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।এছাড়াও আরো বলা হয়- 'সরকার প্রদত্ত ১০০% বেতন ভাতাদি প্রাপ্তির পরও প্রধান শিক্ষক প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন বাবদ ২৩ হাজার ৪৮০ টাকা এবং মনগড়া ‘বিশেষ ভাতা’ নামক খাতে ৮ হাজার ৭০০ টাকাসহ মোট ৩২ হাজার ১৮০ টাকা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিল থেকে প্রতি মাসে অবৈধভাবে উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। শিক্ষক/কর্মচারীদের স্কুল প্রদত্ত ভাতাদি বন্ধ রেখে প্রধান শিক্ষক শোকরানা শিক্ষক/কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপি নীতিমালা ২০১২১ অনুযায়ী আয়া, নৈশ প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা জেএসসি বা জেডিসি অথবা এর সমমান সনদ লাগে। এবং বয়স হতে হয় অনুর্ধ্ব ৩৫ বছর । গত বছরের ১৭ নভেম্বর আয়া, নৈশ প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর তিনটি পদের জন্য আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা কম এবং বয়স বেশি হওয়ায় মোছা. লিপা আক্তার ও মো. খোকন যোগ্য প্রার্থী না হলেও তারা যথাক্রমে আয়া ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে আবেদন করেন। আবেদনের সময় তারা উভয়েই অষ্টম শ্রেণি পাসের ভুয়া অভিজ্ঞানপত্র জমা দেন। এছাড়া বয়স লুকাতে উভয়েই জাতীয় পরিচয় পত্রের কোন ফটোকপি আবেদনপত্রের সাথে সংযুক্ত করেননি।
অভিযোগ, এরপরও আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানা উভয়ের আবেদনপত্র বৈধ হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানা নিয়োগ বোর্ডকে প্রভাবিত করে উভয়ের নিয়োগ চূড়ান্ত করেন এবং গত ১১ জানুয়ারি ম্যানেজিং কমিটির মিটিংয়ে এই নিয়োগ অনুমোদন করান। এর ধারাবাহিকতায় উভয়েই এমপিওভুক্ত হন এবং সরকারিভাবে বেতনভাতা উত্তোলন শুরু করেন। কিন্তু গত ২৮ মার্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নতুন কমিটি এলে ভুয়া নিয়োগের ব্যাপারটি সামনে আসে।
জানা গেছে, নতুন সভাপতি হিসেবে বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পান অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বাবু।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় তার সাথে। এ ব্যাপারে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বাবু জানান, ভুয়া সনদে প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানা দুইজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। বিষয়টি আমাদের কাছে ধরা পড়েছে। প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ বাণিজ্যের কারণে এমনটি হয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন শোকরানা বিদ্যালয়ের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত করেছেন। এর মধ্যে তিনি ২০২২ সালে বিদ্যালয়ের আয় দেখিয়েছেন এক কোটি ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ১০ টাকা এবং ব্যয় দেখিয়েছেন এক কোটি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৮০৫ টাকা। এখানে ৩১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৫ টাকা বেশি খরচ তিনি কোথায় করলেন, তার কোন সদূত্তর পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালে তিনি আয় দেখিয়েছেন এক কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ১৪৮ টাকা এবং ব্যয় দেখিয়েছেন এক কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৪৭ টাকা। এখানে ১৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪০১ টাকা উদ্বৃত্ত থাকলেও সে টাকা কোথায় আছে, এই হিসাব তিনি দিতে পারছেন না। একইভাবে শুধু ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের বেতন, ভর্তি ও সেশন ফি থেকেই বিদ্যালয়ের আয় এসেছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু ব্যাংকে জমা দেখানো হয়েছে ৩৪ লাখ ৭৮ হাজার ৪৫ টাকা। বাকি ৯ লাখ ৭১ হাজার ১৫৫ টাকার কোন হদিস নেই। এছাড়া বিদ্যালয়ের ২৫ লাখ টাকার এফডিআরের লাভের টাকারও কোন হিসাব নেই। কেবল এসবই নয়, বিশেষ ভাতা, গবেষণা ভাতা, শ্রেণি শিক্ষক ভাতাসহ নানা নামে বিদ্যালয়ের লাখ লাখ টাকা নয়ছয় করেছেন শোকরানা।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রধান শিক্ষক শোকরানার মোবাইল (০১৭১১ ৩৬০৯০৬) নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।