"শিয়াল কুকুরের চেয়ে চতুর, তবু মানুষ কুকুর পোষে, কারণ সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ততা বেশি প্রয়োজন। তিনি শিয়াল পুষে ভুল করেছেন।"
গিয়াস আহমেদের 'হ্যালো, ভালো আছো' পড়তে গিয়ে উপরের অংশটি পড়ে ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলাম । মনে হলো, সত্যিই তো! নিজের অজান্তে আমরা আশেপাশে শিয়াল পুষি। ধূর্ত শিয়াল। যারা বিশ্বস্ততার তোয়াক্কা করে না, বোঝে কেবল নিজের স্বার্থ।
দুই টার্মের প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রী ইয়া সিন মোস্তফা আলি; সুশিক্ষিত, সৎ, পরোপকারী, শিল্পমনা। তিনি সদ্য অবসরপ্রাপ্ত (বাধ্যতামূলক-ই বলা যায়) হয়েছেন। সপ্তাখানেক আগে জানতে পেরেছেন তাঁকে নতুন মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। এরপর দ্রুততার সাথে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে বিদায় নিয়েছে সরকারি লোক লস্কর। তিনি নীরবে তাকিয়ে দেখেন কেবল। কোনো শব্দ উচ্চারণ করেন না। বইটি পড়তে গিয়ে ইয়া সিন আলির এই অসহায় নীরবতা পাঠককে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে। পাঠক কেবল অনুভব করবেন, কিছু সময় নীরবতাই শ্রেয়; অতি শব্দে নৈঃশব্দের গভীরতা হারায়।
ধীরে ধীরে ইয়া সিন উপলব্ধি করেন, ক্ষমতাবান মানুষের চারপাশে থাকে তোশামোদকারী-তদবিরবাজদের ভিড়। তাদের উপস্থিতির শক্ত প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধু-স্বজন কাছে আসতে পারে না। তাই তারা ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে অভিমানে।
ঠিক এমনই ভগ্ন মানসিক অবস্থায় হলুদরঙা খাকি খামে একটি চিঠি পান তিনি। প্রেরক মধু ফুম্মার একটি বাক্যে ইয়া সিন আলি দ্রবীভূত হতে থাকেন— 'ভালো থাকিস... দিনকাল ভালো না, নিজের খেয়াল রাখিস রে বাপ...।' এমন নিঃস্বার্থ আর মায়াবী বাক্য কতকাল তিনি শোনেননি! অথচ কিছুতেই তিনি মনে করতে পারেন না মধু ফুম্মাকে। কে এই মধু ফুম্মা? চারপাশে আপনি সম্বোধনের লোক ছিল এতদিন। এমন আবেগে, মায়ায় তুই সম্বোধনের মানুষ যে আছে, তিনি ভুলতেই বসেছেন। শুরু হয় অন্তর্দহণ। মনে পড়তে থাকে দূরে সরে যাওয়া আপনজনদের। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির বন্ধু বান্ধব, বাল্যকালের প্রথম ঘোর, আত্মীয়, যৌবনের তুমুল ভালোবাসা সব তিনি হাতড়াতে থাকেন।
কী নিপুণ হাতে , কী মায়াবী ভাষায় লেখক প্রত্যেকটি চরিত্র, ঘটনার বর্ণনা করেছেন! পড়তে পড়তে পাঠক শুধু মুগ্ধ হতে থাকবেন। নানা প্রশ্ন জাগবে, তারপর ধীরে ধীরে মনোযোগ দিয়ে পড়লে বইয়ের কোথাও না কোথাও উত্তর মিলে যায়, কখনও প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনও পরোক্ষে।
ইয়া সিন আলি সিদ্ধান্ত নেন খোঁজ নেবেন হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের। এক এক করে ফোন করতে থাকেন আর এক একটি গল্প বেরিয়ে আসতে থাকে অতীতের-বর্তমানের।
কিছু জায়গায় লেখক হিন্ট রেখে গেছেন পাঠকের জন্য। যেমন, "ইয়া সিন আলির বুক চিরে একটি দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। কেন কে জানে, সেই নিঃসঙ্গ দোয়েলটার কথা মনে পড়ল তার। বারান্দার হাঁড়িকুড়ির ঘরে যে প্রথম বসতি করেছিল। সঙ্গীহীন সেই দোয়েলের আর সংসার পাতা হয়নি। কেটেছে একেলা তার বিরহের বেলা। হায় পাখি, একলা পাখি!" এই অংশটুকু পড়েই পাঠক তাঁর সূক্ষ্ম অনুভুতি দিয়ে বুঝবেন, ঘর বাঁধলেও দীর্ঘ হয়নি ইয়া সিন সাহেবের সংসারকাল। তাই বাল্যকালের বন্ধু যখন বলেন, '...তোর ঘর সংসারের কথাও জানতে চাই।' তখন ইয়া সিন সাহেবের সাথে সাথে পাঠকও যেন সজাগ হয়ে যান, বুঝে যান, এত বেশি জানার অধিকার সবসময় থাকে না।
রামু আর হারানের মা চরিত্র দুটি লেখকের অনবদ্য সৃষ্টি। কী মমতায় তিনি তাঁদের তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে!
গল্পচ্ছলে ফুটে উঠেছে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। লেখকের 'চন্দ্রযান—দ্য লুনাটিক এক্সপ্রেস' বইটিতেও লক্ষ্য করেছি মাত্র দুই তিনটি পাতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের একটি দুটি ঘটনা টেনে এনে পাঠককে মুহূর্তে নিয়ে যান মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই উত্তেজনাকর সময়টিতে। এই বইটিতেও তিনি সোলায়মান চাচার বর্ণনায় পাঠককে শুনিয়েছেন অসমসাহসী যোদ্ধাদের কথা।
ইয়া সিন সাহেব যৌবনে গভীরভাবে ভালোবাসেন সুলতানাকে। গাঢ় বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়। পরিণয়ের জন্য প্রস্তুত দুই পরিবার। তবু তাদের ঘর বাঁধা হয়নি। কিছু সম্পর্ক থাকে যা তেল, নুন, হলুদ মাখানো হিসাবের খাতা অব্দি গড়ায় না, গড়ায় না বলেই মনের কোণে আজীবন থেকে যায় অমলিন স্মৃতি হয়ে। তাই হয়তো দীর্ঘ দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরও হঠাৎ একদিন ফোন করে বলা যায়, "হ্যালো, আমি।" আহ্, কী গভীরতম শব্দ, কী অধিকারবোধ! যেন এই জগতে 'আমি' একজনই।
বইটি পড়া শেষে পাঠক হিসেবে ঝিম মেরে বসে থেকে ভাবতে হয়েছে ইয়া সিন আলির ভবিষ্যত নিয়ে, তাঁর জীবন নিয়ে, আর এখানেই বোধহয় একজন লেখকের লেখার সার্থকতা।
লেখক গিয়াস আহমেদ এবারও ছাপিয়ে গেছেন পূর্বের গিয়াস আহমেদকে। 'হ্যালো, ভালো আছো' র মাধ্যমে তিনি জীবনবোধের এক অমূল্য আখ্যান লিখেছেন বলে আমি মনে করি। ছোটো খাটো দু চারটে ভুল ভ্রান্তি ছাড়া বড় কোনো ত্রুটি আমার পাঠক দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি।
বইপড়ার এই আকালের দিনে বইটি তার ন্যায্য মর্যাদা পাক! লেখক গিয়াস আহমেদ—এর জন্য মঙ্গল প্রার্থনা সবসময়।