সোমবার, মার্চ ১৭, ২০২৫

বাংলা সঙ্গীতের যাদুকরি এক প্রতিভা ছিলেন আলী হোসেন

  • এ কে আজাদ
  • ২০২৫-০২-১৭ ০০:০২:৩৭

আলী হোসেন। সুরকার-সংগীতপরিচালক। অসংখ্য কালজয়ী বাংলা গানের সুরস্রষ্টা তিনি। উপমহাদেশের অনেক খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পীরা তাঁর সুরে গান গেয়েছেন। বাংলা সঙ্গীতের যাদুকরি এক প্রতিভা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের অনেক চলচ্চিত্রে হৃদয় ছোঁয়া শ্রুতিমধুর গান আছে তাঁর। বহু বিখ্যাত বিখ্যাত চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানের বিকাশে তাঁর অবদান অপরিসীম। 
প্রচণ্ড রকমের অন্তর্মুখী-প্রচারবিমুখ এক মানুষ সংগীতজ্ঞ আলী হোসেন। বহু জনপ্রিয়-কালজয়ী, ভালো ভালো গানের সুরস্রষ্টা হয়েও ছিলেন নিরংহকারী সরল-সহজ, উদার মনের মানুষ।
সঙ্গীতজ্ঞ আলী হোসেনের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি (বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী), যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। প্রয়াত এই সঙ্গীতজ্ঞের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। 
সুরকার-সংগীতপরিচালক আলী হোসেন ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ, কুমিল্লায় তাঁর নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন, পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়ায় । বাবার চাকরির সুবাদে পাকিস্তানের করাচিতে পড়াশোনা করেন । তিনি গ্রাজুয়েশন করেছিলেন।তাঁর বাবা মোহাম্মদ ইয়াকুবের গানের প্রতি দুর্বলতা ছিল।  বাবার কাছেই গানের হাতেখড়ি হয় আলী হোসেনের। করাচিতেই একসময় নজরুল একাডেমিতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর চাকরি হয়। নজরুল একাডেমির উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষক পিয়ারে খানের কাছে তিনি গান শিখেন। এভাবেই ধীরে ধীরে গানের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায়।   
১৯৬৪ সালে আলী হোসেন বাংলাদেশে আসেন। দেশে আসার পর নানাভাবে গানের সঙ্গেই নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। 
১৯৬৬ সালে মুক্তি পায় তাঁর সুর ও সংগীতে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘পরওয়ানা' ।
আলী হোসেন আরো যেসব চলচ্চিত্রের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন তারমধ্যে- ডাক বাবু, অবাঞ্ছিত, নতুন ফুলের গন্ধ, দাগ, ছোটে সাহাব, আনাড়ি, কুলি, নতুন নামে ডাকো, অধিকার, একই অঙ্গে এতো রূপ, অশ্রু দিয়ে লেখা, জীবন নিয়ে জুয়া, বাদশা, খান্দান, সোহাগ, বিজয়িনী সোনাভান, জানোয়ার, রাজা সাহেব, আমির ফকির, আলতাবানু, সানাই, কালো গোলাপ, ঈমান, ঘর সংসার, বউরাণী, ব্যথার দান, ধন-দৌলত, উসিলা, অন্যতম।
আলী হোসেন ১৯৮৯ সালে ‘ব্যথার দান’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পুরস্কৃত হন ।
আলী হোসেন সুরারোপিত কয়েকটি জনপ্রিয় কালজয়ী গান- হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ..., ঢাকো যত না নয়ন দু’হাতে, বাদল মেঘ ঘুমাতে দেবে না..., চাতুরী জানে না মোর বধূয়া..., অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান যেন ভুলে যেও না..., আরে ও প্রাণের রাজা তুমি যে আমার..., এ আকাশকে সাক্ষী রেখে, এ বাতাসকে সাক্ষী রেখে..., ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে নিজেরে যে ভুলে যায়, তুলনা খুঁজে না পায়..., কে তুমি এলে গো আমার এ জীবনে..., কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে..., হায়রে কি সৃষ্টি দেখে এ দৃষ্টি..., আমি বাঘ শিকারে যাইমু, বন্দুক লইয়া রেডি হইলাম আমি আর মামু..., আমার স্বপ্নে দেখা সেই তোমাকে...., নতুন নামে ডাকো আমায়..., 
বলো না একবার, এ রাত তোমার আমার...., কেহই করে বেচাকেনা /কেহই কান্দে রাস্তায় পড়ে, ধরবি যদি তারে / চলো মুর্শিদের বাজারে..., চোখ ফেরানো যায় গো, তবু মন ফেরানো যায় না..., ভালোবাসা বিনা বাচাঁ যায় না..., অমন করে যেও না গো তুমি, বুকে আগুন জ্বালিও না তুমি... ইত্যাদি ।
এইসব কালজয়ী, স্মৃতি জাগানিয়া ও প্রাণহরণিয়া গানের সুরস্রষ্টা আলী হোসেন । জীবনবোধে পূর্ণ বাণীর সাথে, ঝর্ণার মতো স্বচ্ছ ও শ্রুতিমধুর যাদুকরী সুরের আবেশে, এইসব অবিস্মরণীয় গানের যাদুকরী সুরকার আলী হোসেন।
নিভৃতচারী প্রচার বিমুখ কিছু মানুষ আছেন, যারা শুধু কাজ করতেই ভালোবাসেন। নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যান আজীবন। তেমন স্বভাবেরই কাজপাগল, সঙ্গীতপাগল মানুষ ছিলেন আলী হোসেন। যিনি বাংলা সঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ  করে গেছেন, অবিস্মরণীয় কালজয়ী গানের মাধ্যমে।
তিনি শুধু আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনাই করেননি, পরম নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন বেতারও টেলিভিশনেও। 
আলী হোসেন চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনীও লিখেছেন। তিনি যেসব চলচ্চিত্রের কাহিনী লিখেছেন তারমধ্যে-  ঈমান, সোহাগ, ঘর সংসার ও বউরাণী অন্যতম। 
ব্যক্তিজীবনে আলী হোসেন, সালেহা খাতুন-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র ছেলে আসিফ হোসেন। তাঁর স্ত্রী ও ছেলে আমেরিকায় থাকেন, তিনিও সেখানেই ছিলেন। 
আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জে বিয়েবাড়িতে ‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ’ এই গানটি আজও শোনা যায়, আগামীতেও শোনা যাবে। হাজার বছরেও এই গানের আবেদন মুছে যাবার নয়। এই গান ছাড়া যেন বাঙালীদের বিয়ের আয়োজনই জমে ওঠে না। এই গানের সুরস্রষ্টা কিংবদন্তি সুরকার আলী হোসেন, সবসময় প্রচারের বাহিরে থাকায় আজীবন রয়ে গেছেন পর্দার আড়ালে। এমন একজন সৃজনশীল সঙ্গীতজ্ঞ, এদেশের সঙ্গীতের জন্য সারাজীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেলেও, তাঁর মৃত্যুতে সে সময়ে রাস্ট্রের পক্ষ্য থেকে কেউ শোক প্রকাশও করেননি । সঙ্গীতজগতের এই মহিরূহ ব্যক্তিত্বর প্রতি আমাদের রাস্ট্রের উদাসিনতা থাকলেও, ‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ’ অন্ততপক্ষে এই গানটির জন্য কিংবদন্তি সুরকার আলী হোসেন হাজার বছর বেঁচে থাকবেন বাঙালীদের হৃদয়ে।


এ জাতীয় আরো খবর