মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আশরাফুল মাখলুকাত। মানবজাতিকে ইসলাম গৌরব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানুষ হিসেবে সবাই সমান মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। পবিত্র কোরআনে (সূরা আত-ত্বীন : ০৪) বলা হয়েছে, 'আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে'। ('অবশ্যই আমি মানুষকে সর্বোত্তম ও সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি'।) মর্যাদার দিক দিয়ে ইসলামে ধনী-গরিব সবাই সমান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারও সবার ক্ষেত্রে এক। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্থাৎ বাকস্বাধীনতা সবার ক্ষেত্রে এক। এক কথায়, মানুষের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকারকে বলা হয় মানবাধিকার। ইসলামে মানবাধিকার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামই প্রথম স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রদান করেছে। মৌলিক অধিকারকেই মানবাধিকার বলে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকারও সবার ক্ষেত্রে সমান। ব্যক্তি স্বাধীনতাও সবার ক্ষেত্রে সমান। ইসলামে মানবাধিকার বলতে সেসব অধিকারকে বোঝানো হয়, যেগুলো স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তার বান্দাকে প্রদান করেছেন। পৃথিবীর কেউ তা রহিত করার অধিকার রাখে না। (সূরা আল-ইমরান : ১১০) বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, মানবের কল্যাণের জন্য‘। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ইসলামে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানবতাবোধ মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ; বরং এটিই মানুষের শ্রেষ্ঠতম মানবিক গুণ। মানবতাবোধ হলো, মানুষের জন্য অনুভূতি, মানবিক চেতনা, মানুষের কল্যাণ কামনা, মানুষের দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হওয়া এবং মানুষের সুখ-শান্তিতে আনন্দিত হওয়া। কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে পরিচালিত জীবনাচার। যুগে যুগে মানবতার মুক্তি ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার আশাবাদ শুনিয়েছেন বিভিন্ন মহামানব।
আমাদের সমাজের অনেক গুণীজন যাঁদের ক্ষুরধার লিখনীতে সাহিত্য হয় সমৃদ্ধ, সমাজের অন্ধকার হয় আলোকিত, দূর হয় কলুষিত, বিবেক হয় জাগ্রত এবং সংস্কৃতি চর্চায় উঠে আসে সমাজের বাস্তব চিত্র। সাহিত্য সবসময় মানব সমাজে একটি জীবন্ত ও গতিশীল শক্তি হিসাবে বিরাজ করেছে। কেবল মানুষের নান্দনিক অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসাবেই নয়, বরং ইতিহাসের কোন কোন পর্যায়ে তো এটা সমাজ পরিবর্তনেও ভূমিকা রেখেছে। বৃহত্তর পরিসর থেকে দেখলে, সাহিত্য কেবল মানুষের সৌন্দর্যবোধ, নান্দনিক অনুভূতি আর কল্পনার বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং এতে সংশ্লিষ্ট সমাজের নানা ছবি ফুটে ওঠে। তাই কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, যারা নিজেদেরকে সচেতন নাগরিক হিসাবে দাবি করে থাকি তারা কখনো সমাজ ও জাতির প্রতি দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যকে অবহেলা করতে পারি না। সাংবাদিকেরা সমাজ ও জাতির জাগ্রত বিবেক, আর গণমাধ্যম পত্রপত্রিকা সমাজের দর্পণ। তাই সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি, অসংগতি, দুর্নীতি, বৈষম্য বিভেদ এবং চলমান যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলো লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরে থাকেন। আমি মনে করি একই সাথে মানুষের মৌলিক অধিকার, অস্তিত্ব রক্ষা, নীতি-নৈতিকতার উন্নয়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন, এ বিষয়গুলোতেও আমাদের লেখনীর মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করার প্রতি গুরুত্ব দেয়া খুবই দরকার। প্রত্যন্ত-অঞ্চল, অজ-পাড়াগাঁ, ছিন্নমূল পর্যায়ে মানুষের কল্যাণে তাদের পাশে দাঁড়ানো, সমাজের যাবতীয় অন্যায় অত্যাচার, ব্যাভিচার, কুসংস্কার, বাল্য বিবাহ, নারী নির্যাতন, এমন যাবতীয় অসামাজিক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সাধারণ জনগণের ভিতর সচেতনতা সৃষ্টি করার প্রতি খুবই গুরুত্ব দেয়া দরকার। সব ধরনের কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়া ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কুসংস্কার একটি সামাজিক ব্যাধি, যা সমাজের অধঃপতন ঘটায়; সমাজের মধ্যে অশান্তি ও অমঙ্গল টেনে আনে; এর কারণে সামাজিক অবক্ষয় ঘটে। তাই এ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।
সকল প্রকার দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন কর্মকাণ্ডের জন্য শুধু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নয়; সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করা প্রয়োজন, একই সাথে সকল প্রচার-প্রচারণা ও সম্প্রচারে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দেয়া দরকার। আল্লাহ প্রদত্ত পয়গাম ও ইসলামি শরিয়ার আলোকে মানুষের সামাজিক জীবনের সৌজন্যমূলক আচরণ, শিষ্টাচার, সৎকর্মশীলতা ও উন্নত নৈতিকতাকে ইসলামি সংস্কৃতি বলা হয়। মানুষের জীবনের সব কর্মকাণ্ডই ইসলামি সংস্কৃতির আওতাভুক্ত, যা মানবতার আদর্শ মুহাম্মদ (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ইসলামি সংস্কৃতির আরেক অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো মানবতাবোধ। যে আচার, ক্রিয়া, রুচি ও চেতনা জীবনকে সুন্দর করে, সুষমামণ্ডিত করে, শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করে, সেসব আচারের প্রতিফলন হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতি। এর মূলে আছে আল কোরআন ও মহানবীর জীবনে তার বাস্তবায়িত রূপ। শান্তি, সুখ, স্বাধীনতা ও সর্বজনীন কল্যাণই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। মানবাধিকার বাস্তবায়নে শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতির অগ্রগতি ও শিক্ষা সচেতন বিকাশ সাধনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম, তাই স্কুল-কলেজ শিক্ষাঙ্গন; কোথাও যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয় এবিষয়ে ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক সবাইকেই স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন ও সবার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করাটা খুবই জরুরী। অসহায় নিরীহ জনগণ যেন তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সকল ক্ষেত্রে আইনি শাসন পায় এবং মানবাধিকারে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে যেন সবাই সুখী সমৃদ্ধি শান্তিময় জীবন যাপন করে; একটি সুষ্ঠু সুন্দর সমাজ ও উন্নত জাতি হিসাবে আমরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারি, এই হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক- সাংবাদিক ও সমাজকর্মী, আবু জাফর বিশ্বাস। চৌগাছা, যশোর।