উ ম্মে কু ল সু ম (ঝুমু)

  • অভিমানের খেয়া
  • ২০২৫-১১-০৫ ২১:২৯:৫৪
image

ঘুম থেকে উঠে লীনা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো রেডি হওয়ার জন্য। মনে হলো, চোখ দিয়ে তাকাতে একটু ঝাপসা লাগলো। মানে, চোখ খুললেই যেন কাঁটার মতো বিঁধে কিছু-একটা। আবার ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে পানির ঝাপটা দিলো কয়েকবার। তারপরও কেমন যেন লাগছে। তোয়ালেটা মুখে ভাপ দিয়ে কয়েকবার চেপে ধরলো চোখে। আবার তাকালো। না, কিছু একটা ঝামেলা হচ্ছে। আবার আয়নায় তাকাতেই দেখলো, ভূতের মতো চোখ লাল হয়ে আছে। দেখতেও মনে হলো, ঝাপসা লাগছে। আচ্ছা, ভূতের মতো লাল বলে নীলা ভাবলো, ভূতের চোখ কি লাল হয়! এযাবৎকাল ভূতের যে গল্প শুনেছি, আচ্ছা, ভূত বলতে কি কিছু আছে? যদি থাকেও, তাহলে ভূতের চোখ কি লাল হয়? যদি এগুলো কাল্পনিক হয়, তাহলে ভূতের মতো লাল চোখ- এই কথাটা মাথায় ঢুকলো কিভাবে! ধেৎ, কোথা থেকে যে কোথায় যাই, আল্লাহই জানেন।
লীনা খুব-একটা মেকআপ কখনোই নেয় না। যেহেতু বাড়তি মেকআপ নেয়ার ঝক্কি-ঝামেলা নেই, মানে, লীনা মেকআপে অভ্যস্ত নয়, তাই ঝাপসা চোখে খুব-একটা ঝামেলা হলো না। তবু পাশে শিপনকে পেয়ে বললো, ‘দেখ তো, আমার চোখে কিছু হয়েছে কিনা!’
কিছু না দেখেই
কী হবে?
কেমন যেন ঝাপসা লাগছে।
ও কিছু না।
দেখোই না।
চোখ টেনে বড় করে দেখে বললো, ‘বললাম না, কিছু হয়নি।’
আমার তো মনে হচ্ছে, চোখের ওপরে বড় কোনো পর্দা দেয়া। তাকালেই
মাথায় চাপ লাগছে।
ও তোমার মনের ভাবনা। কাজ না থাকলে যা হয়।
হবে হয়তো।
শিপনের ধারণা, আমি সংসারে কোনো কাজ করি না, সব অটো হয়ে যায়। আমার কোনো শরীর খারাপ, প্রয়োজন, চাহিদা, শখ- এসব থাকতেই পারে না। ধেৎ, এই হচ্ছে ব্রেইনের ঝামেলা। সুযোগ পেলেই এটা-সেটা নিয়ে ভাবতেই থাকে।
চুলগুলো ঠিক করে একটু ভ্যাসলিন আর পারফিউম; অবশ্য সানস্ক্রিন দিতে কোনোভাবেই ভুল হয় না। এতকিছু করেও সানব্লক তো করা যায় না। কিভাবে মানে, জোরপূর্বক ত্বককে স্পর্শ করা চাই-ই চাই। তবে সানের মনে হয় চারিত্রিক প্রবলেম আছে। হাঃ হাঃ, ত্বকের প্রতি তার ভীষণ দুর্বলতা। শিপনের ডাকে ভাবনারা উধাও। দেরি করো না, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তারপর দু’জনে মিলে বাইরে গেল। গাড়িতে দু’জনার কখনোই খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। শিপন প্রয়োজনীয় ফোনগুলো সেরে নিচ্ছে। লীনা ফেইসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করছে। কিন্তু চোখ কিছুতেই সহায়ক হচ্ছে না মোবাইল ফোনসেটের দিকে তাকাতে। মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালেই মাথায় যেন চোট লাগছে।
কী আর করা। মাঝেমধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই এমনটা হতে পারে।
তাছাড়া শিপন তো নিজে দেখলো, চোখ নর্মাল, কিছুই হয়নি।
চালশে হলে হয়তো এভাবে না বলে মনের কোণে মেঘ জমে। কখনো বা মুষলধারে বৃষ্টি হয়, আবার কখনো ভীষণ খরা।
শিপনের প্রতি বিশ্বাস থেকে আজকের দিন ভালোই কাটলো।
রাতে খুব একটা ঘুম হয়নি।
টেনশন থাকলে লীনা কখনোই ঘুমাতে পারে না। সকালে বাচ্চাদের স্কুল- এই টেনশনে লীনা অনেক রাত নির্ঘুম থেকেছে। এখন নিজের পরীক্ষা। মানে, ল’ পরীক্ষা চলছে। বিভিন্ন ব্যস্ততায় প্রিপারেশন খুব একটা ভালো নয়। তো এখানে আরো বাড়তি টেনশন যুক্ত হয়েছে। পরীক্ষার হলে যাওয়ার পর মণি, মানে লীনার পাশের সিটের পরীক্ষার্থী বললো-
তোমার চোখ এত লাল কেন?
লাল?
হুঁ।
রাতে ঘুম হয়নি, সেজন্য হয়তো।
ও আচ্ছা।
এর মধ্যে পেপার দিলো। পেপার দিলেই বুকের মধ্যে ধুকপুকানি শুরু হয়। প্রশ্ন হাতে পেলেই নার্ভাস হয়ে যায় লীনা। পাঁচ মিনিট খুব চাপে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে ঠিক হয়। এটা ছোটবেলা থেকেই। লীনা যেন এখনো সেই ছোট্ট লীনা। প্রশ্ন দিলো। লিখতে গিয়ে যত ঝামেলা শুরু হলো। সব ঝাপসা লাগছে। চশমা আছে, তবু এমন ঝাপসা কেন। রোল নাম্বারটা মনে হয় লেপ্টে গেছে। মণিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দেখো তো, নাম্বারটা কত?’
লজ্জা লাগলো, তবু তো লিখতে হবে।
মণিও একবার আমার দিকে তাকালো।
মনে মনে কী ভাবছে, কে জানে!
হয়তো মনে মনে ভাবছে, ‘পরীক্ষা দিতে এসেছে, অথচ রোল নাম্বার বলে দিতে হয় অন্যকে। কী যে লিখবে আর এরা যে কেন আসে, বুঝতে পারি না।’ বলা এবং ভাবা দুটোই যুক্তিসঙ্গত। মণির সাথে আগে কোনো পরিচয় ছিলো না। পরীক্ষা দিতে এসেই পরিচয়। আগে কখনো দেখা হয়নি লীনার সাথে মণির। তবে দুটো পরীক্ষার মধ্যেই ভীষণ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তবে এতটাও নয় যে, রোল নাম্বার জিজ্ঞেস করা যায়।
লিখতে গিয়ে আরো দুরবস্থা। মনের চোখ খুলে তারপর প্রশ্ন দেখতে হয়েছে।
একাধারে চোখ থেকে পানি ঝরছে, যেন কোনো প্লাবন।
লীনা মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছে। তবু মনের জোরে পরীক্ষা শেষ করলো। বিকালে আবার একটা প্রোগ্রাম আছে। বাসায় এসে আয়না দেখে ভয় পেলো। এ কী, চোখ এত লাল কেন? তাহলে যে চোখে ব্যথা হয়, এমনটা হলো! চোখে সমস্যা হয়েছে বলে ডাক্তারকে কল দিয়ে ড্রপ এনে চোখে দিচ্ছে। গরম পানি করে পাতলা কাপড় দিয়ে সেক দিচ্ছে ডাক্তারের কথামতো।
বাহ্, জাদুর মতো চোখ আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।
মনে হয়, কিছুই হয়নি। যাক, শান্তি। ডাক্তারকে মনে মনে অনেক দোয়া। আজকাল পরিচিত না হলে এই পরামর্শের জন্য চেম্বারে যেতে হতো পনেরোশ’ টাকা ভিজিট, তারপর অপেক্ষা। এই ডাক্তারসাহেবের সাথে পরিচয় প্রায় বারো বছর যাবৎ। আল্লহামদু লিল্লাহ অনেক হেল্পফুল।
রাত ৯টার মতো হবে। একটা প্রোগ্রাম চলছে, লোকজন গমগম করছে। হঠাৎ লীনার বড় বোন চোখের দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো।
লীনা, তোর চোখ এত লাল কেন?
কী হয়েছে, অস্বাভাবিক লাল!
অস্থির হয়ে এবার কেঁদেই ফেলবে।
লীনা, তোর কী হয়েছে? তোকে তো ডাক্তার দেখাতে হবে।
লীনার বড় বোন এমনিতেই সহজ মনের মানুষ।
অতিরিক্ত ভালোবাসা অনেক সময় বিড়ম্বনার হয়। লীনা ‘কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
এত মানুষজন, তারা যদি ভাবে, চোখ উঠেছে, সবার খুব মন খারাপ হবে। এই ছোঁয়াচে রোগকে এখনো মানুষ বাঘের চেয়ে ভয় করে। সবাই ভাববে, লীনা ভাবির চোখে ব্যথা, আমরা তার প্রোগ্রামে গিয়ে আমাদের এই অবস্থা। আবার কেউ বলবে, চোখে ব্যথা নিয়ে না এলেই হতো। আবার অনেকে কানাকানি করবে, কাজটা কি ঠিক করলো।
সুরাইয়া ভাবি শুনলে খবর আছে। সে তো বলবে, ‘আমার চোখ এখনই কেমন করছে, আর এসব তো খুবই ছোঁয়াচে।’ আর বলাটাও খুব স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রে এমন হলে আমিও বলতাম।
এর মধ্যে লীনার বড় বোন আবার বললো, ‘তুই কিছু না বললে হবে।’
এমন লাল কি এমনি এমনি হয়!
তাড়াতাড়ি অবস্থা সামাল দেয়ার জন্য লীনা বললো, ‘আপা, ও কিছু না। চোখে দেয়ার সময় কাজল চোখের মধ্যে লেগেছে, তাই এমন অবস্থা।’
লীনার বড় বোন এখন তো কেঁদেই ফেলবে। বললো, ‘না না, নর্মাল কিছু নয়।
এমনিতে তো চোখ এমন লাল হতে পারে না।’
ওমা, এ তো আরো সাংঘাতিক! কোনোভাবেই লীনা তার বোনকে বোঝাতে পারছে না। বললো, ‘আপা, বিশ্বাস করো, ও কিছু না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বলে বাসায় এলো লীনা।
ফ্রেশ হয়ে আয়নায় তাকাতেই দেখলো, ভয়াবহরকমের লাল। ভূতুড়ে লাল, মানে অস্বাভাবিক।
চোখ এত লাল যে, লাল ছাড়া চোখের আর কিছুই দেখা যায় না। লীনা শিপনকে বললো, ‘দেখো তো, কী অবস্থা।’
একবার তাকিয়ে শিপন বললো, ‘হুঁ, চোখ একটু লাল হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে। ঠাকুরমশাই যখন বলেছেন, ঠিক হয়েও যেতে পারে।’
অভিমানের একগাল হাসি দিয়ে লীনা এপাশ-ওপাশ করছে, তবু কোনো কথা বলছে না।
নিজের কাছে নিজের অনেক প্রশ্ন, যার উত্তর সবটা লীনার জানা নেই। নদী আর জীবনের হয়তো এখানেই ভীষণ মিল- যত বাধা আসুক, চলতে হবে। দীর্ঘশ্বাসের ঢেউখেলানো বাতাসে লীনা দুঃখগুলো ভাসিয়ে দিয়েছে। শিপনের ওপর লীনার অনেক অনেক অভিযোগ, স্বেচ্ছায় লীনা সবকিছুর দায় নিজেই নিয়েছে।
এভাবে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছে।
সকালে উঠতে একটু দেরি করে ফেলেছে। বাচ্চাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য ডাক-ে লা। বাচ্চা আলসেমি করছে। লীনাও বাচ্চাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘুম ভেঙে উঠে দেখলো, সকাল ১১টা। দেখলো, শিপন বিছানায় নেই। লীনা ভাবলো, হয়তো ওপাশে আছে।
চোখ খুলে তাকাতেই লীনা শিপনের পাল্টানো কাপড় দেখে ভেবে নিলো, ও বাইরে গেছে।
বাচ্চার সাথে গড়াগড়ি করে উঠতে যাচ্ছে আর বাচ্চা টেনে ধরছে- এভাবে আরো ঘণ্টাখানেক। বাচ্চাকে নিয়ে এটা লীনার প্রায়ই হয়। স্কুলের জন্য ডেকে যাচ্ছে, বাচ্চা ঘুমের মধ্যে মোড়ামুড়ি করলো। লীনা সিদ্ধান্ত নিলো, আজ স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। কী আরাম করে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে, থাক স্কুলের দরকার
নেই। কেন যে স্কুল এত সকালে শুরু হয়। আহারে, বাচ্চাগুলো অসহায়ের মতো ব্যাগভর্তি করে রানারের মতো ছুটে চলে। এরা না বুঝেই পুরো পৃথিবীটা কাঁধে ঝুলিয়ে চলছে আগামীর দিকে।
বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো লীনা।
হঠাৎ মনে হলো, মাথা কেউ চেপে ধরেছে। প্রচণ্ড মাথাব্যথা একদম অসহ্য, আবার এসে শুয়ে পড়লো। চোখ আগের মতো লাল নেই, তবে চুলকাচ্ছে। লীনা কিছুক্ষণ চোখ কচলে নিলো, কিন্তু চুলকানি কমছে না। চোখে ঝাপসা লাগছে। কোনোকিছুর দিকে তাকালে চোখে প্রেসার দিতে হচ্ছে, তবু হিজিবি-জি লাগছে। লীনা উঠে বাচ্চাকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিলো। তারপর একটা টাফনিল খেয়ে কড়া করে এককাপ কফি নিয়ে বসলো। মাথায় অসহ্য ব্যথা। কফির মগ রেখে আবার গিয়ে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ বমির বেগ। কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারলো না। ২-৩ বার বমি হলো। লীনা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। মাথাব্যথা কিছুতেই কমছে না। লীনার যত কষ্ট হচ্ছে মাথাব্যথা আর চোখব্যথায়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে শিপনের অবহেলায়। শিপন চোখ দেখেও এমন করে বলতে পারলো! একটাবার খেয়াল করলো না! যত কাজ থাকুক, যত ব্যস্ততা থাকুক, এমন তো করতে পারে না। সারাদিন গেল, একটা পরিপূর্ণ রাত কেটে গেল, বাসায় ঘুরলো-ফিরলো। বাসার সাহায্যকারী মেয়েটিও লিনার চোখ দেখে বললো, ‘আন্টি, আপনার চোখের কী অবস্থা।’ আর শিপন একবার জানতেও চাইলো না। এই সম্পর্কে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলো। অবশ্য লীনা খুব-একটা অসুস্থ হয়নি কখনো। শিপন অসুস্থ হলে কী না করে লীনা। ওর ভালোলাগার জন্য নিজের কত ভালোলাগাকে জলাঞ্জলি দেয়, আর ও...।
লীনা মন খারাপ করে বারান্দায় গিয়ে বসে আছে। যতটা কষ্ট পাচ্ছে চোখের ব্যথা বা মাথার যন্ত্রণায়, তার চেয়ে কষ্ট পাচ্ছে এমন নির্মম অবহেলায়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে লীনা দুটো পাখির ওড়াউড়ি দেখলো। প্রায়ই এই পথে পাখির আনাগোনা হয়। বহুবার লক্ষ করেছে লীনা, তবে আজকের মতো করে কখনো দেখেনি। যেন প্রিয়জন হারিয়ে পাগলের মতো ঘুরছে, নাকি কোনো প্রিয়জনকে খুঁজছে অথবা নীড় হারিয়ে অসহায় হয়ে ভবঘুরের মতো ঘুরছে। লীনা ওদের দেখে হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বুঝে নিলো, আসলে ওর থাকা-না থাকায় কিছু আসে যায় না। ও অহেতুক একটা জায়গা দখল করে আছে, যার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। বেলাশেষে একরাশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়া লীনার কাছে অবশিষ্ট কিছু নেই।
এবার লীনার বাঁচতে হবে নিজের জন্য। অভিমানের অবহেলায় নিজেকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে নেই। কারো অবহেলায় জীবন থমকে যেতে পারে না। এর মধ্যে ছেলে ডাকলো, ‘আম্মু, ক্ষুধা লেগেছে।’ ছেলের ডাকে অভিমানের খেয়া পাড়ি দিয়ে তরী ভিড়ালো ছোট্ট ভালোবাসার ঘাটে। লীনা এসে ছেলেকে
খাবার দিলো। মোবাইল ফোনসেটটা চাপ দিতেই দেখলো, ৫টা ২১। তাড়াতাড়ি আই হসপিটালে ফোন করলো। জানতে চাইলো, ডাক্তার আছে কিনা?
ছেলেকে একা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। আজকাল যা হচ্ছে, কাজের মেয়ে বাচ্চা সহ উধাও হয়ে যায়, আবার বাচ্চা রেখে জিনিসপত্র নিয়ে উধাও। অবশ্য এই মেয়েটাকে নিয়ে এসব ভয় নেই, তবু সাহস হয় না বাসায় রেখে যেতে। শিপনকে কল করে জানালো, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, যাওয়ার সময় বাবুকে অফিসে রেখে গেলে নিশ্চিন্ত থাকতো। শিপন ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দুই দিন পরে করাতে বলে কল কেটে দিলো। ফোন রেখে লীনা পাশের বাসায় বাবু আর বাসার মেয়েটাকে রেখে ডাক্তারের কাছে তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিলো। রাস্তায় বেরোলেই যানজট। অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে, তবে সময় যেন দ্রুত ছুটে চলেছে। কত কথা যে লীনার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। শিপনের আচরণগুলো চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসছে। সত্যিই তো, কখনো সামান্যতম গুরুত্ব দেয়নি লীনাকে, তবু পাগলের মতো নিজের সংসার ভেবে সবকিছু আগলে রেখেছে। শিপনের তাচ্ছিল্যকে ভেবেছে ব্যস্ততা। এভাবে তো জীবন চলতে পারে না। লীনা খুব বেশি আসক্ত হয়েছিল শিপন আর সংসারের প্রতি। ওর যে একটা জীবন আছে, সেখানে ইচ্ছা-ভালোলাগা থাকতেই পারে- এসব দিব্যি ভুলতে বসেছে।
গাড়ি আই হসপিটালের সামনে। নেমে প্রাথমিক কাজ সেরে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকটা অপেক্ষার পর ডাক্তার ডেকে নিয়ে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললো, ‘এত দেরি করেছেন কেন।’ বুঝতে পারেনি লীনা। আপনারা শিক্ষিত সচেতন মানুষ হয়ে যদি এমন করেন, তাহলে গ্রামের
সাধারণ মানুষ কী করবে?’
লীনা তখন ঘামছে। জানতে চাইলো, ‘কী হয়েছে?’
ডাক্তার বললো, ‘টেস্টগুলো করুন, রিপোর্ট দেখে তারপর বলি।’
লীনা টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে এলো।
কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখে ডাক্তার বললো, ‘গ্লুকোমা।’
আমি কি অন্ধ হয়ে যাবো?
আপনি তো আধা-অন্ধ হয়ে গেছেন।
মানে কী?
বুঝতে পারছেন না!
করণীয় কী আছে?
চোখ দিয়ে কী করবেন? প্রয়োজন থাকলে তো আগেই আসতেন।
লীনা উঠে দাঁড়ালো।
চলে যাচ্ছেন?
হুঁ।
কী করবো, কোনো সমাধানের কথা তো বলছেন না! অহেতুক কথা শোন-াচ্ছেন।
অকারণে সময় নষ্ট করার মতো সময় কোথায়! লীনার কারো কথা শোনার মানসিকতা আর নেই।
ডাক্তার বললেন, অপারেশন করতে হবে।
অপারেশন! কত সময় লাগবে?
আপনি কি বুঝতে পারছেন, আপনি কি জানেন, গ্লুকোমা হলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়।
আপনি খুব অস্থির হয়ে আছেন, শান্ত হয়ে বসুন। ছোট একটা সার্জারি লাগবে।
লীনা যেন নিথর শান্ত হয়ে আছে।
এর মধ্যে লীনার ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরে বললো, ‘আসছি।’
উঠে রওয়ানা দিলেন।
ডাক্তার ডাকলো, ‘আবার চলে যাচ্ছেন যে।’
যেতে হবে।
দুই-চার দিন দেরি হলে কি অপারেশন করা যাবে না?
‘হুঁ যাবে।’- ডাক্তার একটু অবাক হয়ে লীনার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ডাক্তারকে বললো, ‘আগামীকাল ফোন করে আসবো।’
জি।
তিন-চার দিনে খবর নেই। বাচ্চার জ্বর।
সাত দিন পরে লীনা হাজির ডাক্তারের কাছে। অনেক সময় অপেক্ষার পর
ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ মিললো।
ডাক্তার জানতে চাইলো, ‘অবশেষে আপনার সময় হলো?’
লীনা একটু হেসে বললো, ‘সময় কোথায় সময় নষ্ট করার?’
সাথে কে আছে?
একা হলে কি অপারেশন হবে না?
ডাক্তার একটু অবাক হয়ে বললো, ‘এমন তো বলিনি।’
অপারেশন হলো।
লীনা বাসায় ফিরে বাচ্চাকে নিয়ে খেলছে।
শিপন বাসায় ফিরে বললো, ‘কী অবস্থা?’
লীনা বললো, ‘চলছে।’
এরপর সত্যিই চলে যাচ্ছে। লীনা চাইছে না, ওর জীবনের কোনো বিষয় অন্তত
শিপনের সাথে শেয়ার করুক। লীনা যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে সংসার টেনে নিচ্ছে। তবে লীনার নিজস্ব একটা জগৎ হয়েছে, হোক সেটা একাকী, দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণ। ক্রমাগত অভিমানগুলো অবহেলার তরী বেয়ে অনিশ্চিত আগামীর দিকে কেবল বয়ে যাচ্ছে।