ফুলবাড়ীগেট প্রতিনিধি ঃ দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান শিরোমনি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় আজ (শুক্রবার) থেকে শুরু হচ্ছে ৩দিন ব্যাপী ৬৫তম ওয়াজ মাহফিল ও দেস্তারবন্দ অনুষ্ঠান। মাদ্রাসার পাশ^বর্তী শিরোমনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ময়দানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মাহফিলে প্রথম দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন ঢাকা তেজগাও’র মদিনাতুল উলুম কামিল মাদ্রাসার প্রধান মুহাদ্দিস মাওলানা ডঃ আবুল কালাম আযাদ বাশার, বিশেষ অতিথি থাকবেন খুলনার ফুলবাড়িগেট কারিমিয়া মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম মাওলানা মুফতি হুমায়ুন কবীর হুসাইনী। আগামীকাল ৯ নভেম্বর শনিবার শিক্ষার্থীদের দেস্তারবন্দ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ,ফ,ম, খালিদ হোসেন। প্রধান আলোচক থাকবেন মাওলানা তারেক মনোয়ার, বিশেষ অতিথি থাকবেন হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশনের সভাপতি মাওলানা ক্বারী আব্দুল হক, খুলনার দারুল কুরআন সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মনিরুজ্জামান এবং শেষ দিন ১০ ডিসেম্বর রবিবার প্রধান অতিথি থাকবেন মাওলানা মুফতী আমির হামজা, বিশেষ অতিথি থাকবেন খুলনার বায়তুন নূর জামে মসজিদ’র খতিব মাওলানা আবুল বাশার জিহাদী। সভাপতিত্ব করবেন শিরোমনি হাফিজিয়া মাদ্রাসার সভাপতি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল, সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ বছর দেস্তারবন্দ অনুষ্ঠানে ৬জন হাফেজাসহ ৭৫ জন হাফেজকে দেস্তারবন্দ প্রদান করা হবে বলে মুহতামিম হাফেজ মোঃ ইব্রাহিম জানান।
শিরোমনি হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকে খুলনার শিরোমনিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে লোকজন দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে-বিদেশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। ৭/৮ জন শিক্ষার্থী দিয়ে শুরু হওয়া মাদ্রাসাটি বর্তমানে জায়গা ও আবাসন সংকটের কারণে ছাত্র ভর্তি করতে পারছেনা। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জেনারেল শিক্ষায়ও অসামান্য ভুমিকা রেখে চলেছে এ প্রতিষ্ঠান।
ব্রিটিশ আমলে শিরোমনিতে রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণের পর থেকে এ এলাকার আলহাজ¦ আঃ জলিল ফকির, মুন্সী সৈয়দ আহমদ, সূফী আঃ করিম, কাজী মোজাফ্ফর হকসহ আরো কিছু মুরব্বী স্টেশনে বিকাল বেলায় আড্ডা দিত এবং স্টেশনটি টিকিয়ে রাখার জন্য নিজ খরচে ভ্রমণ না করেও টিকেট ক্রয় করতো। তখন আসর ও মাগরীব নামাজ আদায় করার জন্য তারা রেলওয়ের পতিত জমি পরিষ্কার করে তালপাতা দিয়ে একটি পাঞ্জেগানা মসজিদ ঘর তৈরি করে। সে সময় এ এলাকায় মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচারের জন্য শর্শিনার পীর সাহেব আসতেন। সাল ১৯৫৮ আলহাজ¦ আঃ জলিল ফকির , সূফী আঃ করিম, মৌলভী আঃ সালাম, মৌলভী আঃ মালেক যান শর্শিনা মাদ্রাসার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মাহফিলে। ফেরার পথে লঞ্চে বসে উপরোক্ত ৪ জন আলোচনা করেন ছোট করে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার। বাড়ী ফিরে এলাকাবাসীর সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয় মাদ্রাসা স্থাপনের। সিদ্ধান্তানুযায়ী মাদ্রাসাটির বর্তমান সভাপতি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার’র দাদা আলহাজ¦ গোলাম নবী মিয়া (১৫ শতাংশ) ও বর্তমান মুহতামিম হাফেজ মোঃ ইব্রাহীম’র পিতা ডাঃ হামজা আলী (৭ শতাংশ) এর দানকৃত জমিতে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ইটের গাথুনী ও কড়ে-বর্গার ছাদ দিয়ে মাদ্রাসার ঘর নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৯ সালে মাত্র ৭/৮ জন ছাত্র দিয়ে মাদ্রাসার যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় মাদ্রাসা সম্প্রসারণের জন্য পর্যায়ক্রমে আলহাজ¦ গোলাম নবী মিয়া আরো জায়গা দান ও বিক্রয় করেন। ইটের গাঁথুনির ছোট্ট সেই ঘরটি বর্তমানে ৮৬.৫৪ শতাংশ জায়গার উপর ৪তলা উচুঁ ভবন হয়ে দাড়িঁয়ে আছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাক্রম। মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ইবতেদায়ী, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল। এর বাইরে বর্তমানে চালু আছে নূরানী শাখা, বেফাকের অধীনে কওমী শাখা, শুধু হিফজ শাখা, চরমোনাই বোর্ডের অধীনে নুরানী শাখা এবং জেনারেল (বাংলা, ইংরেজি, আরবি, অংক) শিক্ষার সাথে হিফজ্ নিয়ে বিশেষ শাখা। শিরোমনি হাফিজিয়া মাদ্রাসাটি শুধুমাত্র হিফজ্ দিয়ে শুরু হলেও বর্তমান সময়ের চাহিদানুযায়ী ২০০৯ সালে ৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে হিফজ্ শিক্ষার পাশাপাশি বিশেষ শাখা (ইবতেদায়ী ১ম শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত্) চালু করে।
১৯৫৯ সালে ৭/৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হওয়া মাদ্রাসাটির বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮৩০ যার মধ্যে সাধারণ হিফজ শাখায় রয়েছে ৩৪২ জন ও বিশেষ শাখায় রয়েছে ৩৮০ জন এবং ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মহিলা শাখায় রয়েছে ১০৮ জন শিক্ষার্থী। মুহতামিমসহ সাধারণ হিফজ ও বিশেষ শাখায় শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে ৮৮জন।
শিরোমনি হাফিজিয়া মাদ্রাসা তার শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করে থাকে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে উভয় শাখার শিক্ষার্থীরা মিশর, কাতার, সৌদিআরবসহ বিভিন্ন দেশে কর্ম জীবনে যেমন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে তেমনি দেশে রয়েছে অসংখ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা বিদেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় এবং দেশের প্রথম সারির পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে। এ বছর অত্র মাদ্রাসা থেকে উভয় শাখার ৬ জন মেয়েসহ ৭৫ জন শিক্ষার্থী হিফজ্ সম্পন্ন করেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী তাদের হিফজ্ সম্পন্ন করেছে বলে সাধারণ হিফজ শাখার প্রধান হাফেজ মোঃ ইকবাল হোসেন জানান। মাদ্রাসা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশেষ শাখার প্রধান হাফেজ মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, বিশেষ শাখায় বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে মুলধারার শিক্ষা ইবতেদায়ী ও দাখিল’র সাথে হিফজুল কুরআন পড়ানো হয়। জেনারেল ও হেফজখানার শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও মনোরম পরিবেশ থাকায় এ শাখার শিক্ষার্থীরা তাদের ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত্ লেখাপড়া সম্পন্ন করে ঢাকার তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা, দারুন নাজাত সিদ্দিকিয়া মাদরাসাসহ দেশের প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী দেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যসহ মিশর, তুরষ্কে অধ্যয়নরত রয়েছে। এছাড়া ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র দাখিল পরীক্ষায় উপজেলার প্রথম স্থান লাভ এবং উভয় পরীক্ষায় সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী বৃত্তি পেত এ প্রতিষ্ঠান থেকে।
জেনারেল শিক্ষা, হিফজুল কোরআনের পাশাপাশি অত্র মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের তেলাওয়াতের জন্য মিশর থেকে ক্বারী এনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আগামী ২০২৫সালের জানুয়ারী মাসে আবারও মিশর থেকে প্রশিক্ষক এসে ৩/৪ মাস প্রশিক্ষণ দিবে বলে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মুন্সী মঈনুল ইসলাম জানান। অত্র মাদ্রাসা প্রতি বছর আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে পিএইচপি কুরআনের আলো, হুফ্ফাজুল কুরআনের অধীনে খুলনা মহানগরী ও জেলার প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে জাতীয় ও অঞ্চল ভিত্তিক পুরষ্কার লাভ করে। এছাড়া প্রতিবছর মাদ্রাসার উদ্যোগে বার্ষিক তাফসিরুল কুরআন মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে দেশের খ্যাতনামা তাফসিরকারকরা কুরআনের তাফসির পেশ করেন।
মানসম্মত শিক্ষা পাবার আশায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ মাদ্রাসায় পড়তে আসে। ফলে ডিসেম্বর ও জানুয়ারী মাসে খুলনার শিরোমনি এলাকার মাদ্রাসা সংলগ্ন ভাড়া বাসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সৌদি প্রবাসী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, দুটি সনÍানকে এ মাদ্রাসার বিশেষ শাখায় ভর্তি করার আগে তার পরিবারকে ভাড়া বাসা পেতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। অবশেষে অপেক্ষাকৃত বেশি ভাড়া দিয়ে দু’রুমের একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে এখন শিরোমনি এলাকায় থাকছে। ফ্রিল্যান্সার মোঃ আলমাজ হোসেন বলেন, আমার সন্তানকে কোরআনের শিক্ষা দিতে গিয়ে খোজঁ খবর নিয়ে শিরোমনি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করায়, তবে আমাকে বাসা পেতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল।
শিরোমনি হাফিজিয়া মাদ্রাসার বিশেষ শাখা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত্ হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ মান সম্মত উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অভিভাবকরা চাই এ মাদ্রাসাটি কমপক্ষে আলিম শ্রেণী পর্যন্ত্ উন্নীত হোক। কিন্তু হাফিজিয়া মাদ্রাসার সীমানা সংলগ্ন আলিম মাদ্রাসা থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছেনা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সেক্রেটারী হাফেজ মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, জায়গার সংকটে আমরা মাদ্রাসার পরিধি এখানে আর বাড়াতে পারছিনা। তবে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তানুযায়ী শিরোমনি ও তেলিগাতি মৌজার সীমান্ত এলাকায় ইতোমধ্যে সাড়ে ৪ একর জমি ক্রয় করা হয়েছে। আরো ৬/৭ একর জায়গা ক্রয় করা প্রয়োজন। শিরোমনিতে থাকবে শুধু হাফিজিয়া মাদ্রাসা আর তেলিগাতি এলাকায় হবে বিশেষ শাখার ক্যাম্পাস, আদর্শ একটি স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাস (প্রস্তাবিত) এবং বালিকা বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস।
মাদ্রাসার মুহতামিম হাফেজ মোঃ ইব্রাহিম বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, ১৯৯৮ সালে এ মাদ্রাসার মুহতামিম হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে চেষ্টা করছি গুণগত মানসম্মত হাফেজ তৈরির মাধ্যমে দ্বীনের খেদমত করার। মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার’র সুচিন্তিত দিক নির্দেশনাসহ অন্যান্য সদস্যমন্ডলীর নিবিড় তত্বাবধায়ন, শিক্ষক মন্ডলীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাদরাসাটি ইতোমধ্যে দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, এলাকার মুরব্বীদের অনুরোধে এমপি থাকাকালীন সময়ে ২০০২ সালে সভাপতি হিসাবে দ্বায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে চেষ্টা করছি মাদ্রাসাটিকে একটি আদর্শ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার। তবে রাজনৈতিক কারনে ২০১০ সালের পর থেকে দীর্ঘ কারাবাসের কারণে আমি মাদ্রাসার দেখভাল সঠিকভাবে করতে না পারলেও আমার নির্দেশনানুযায়ী পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ, মুহতামিম, বিশেষ ও হিফজ শাখার প্রধানসহ অন্যান্য শিক্ষকমন্ডলীর আন্তরিকতায় মাদ্রাসা আজ এ পর্যায়ে পৌছেছে। তবে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পাওয়া ২য় স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে সকলকে নিয়ে শুধু দক্ষিণবঙ্গে নয় দেশ ও বিদেশের দরবারে মাদ্রাসাটি যাতে গৌরাবান্বিত ভুমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে অগ্রণী ভুমিকা রাখব ইনশাআল্লাহ।