প্রেক্ষাপট
২০১৮ সালে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। ১৯৭২ সাল থেকে চালু হওয়া কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। লাগাতার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটাব্যবস্থার সংস্কার না করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী আদেশ বলে সংসদে কোটা ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেন এবং পরবর্তীতে সরকার পরিপত্র জারি করে।
কোটা নিয়ে নতুন করে সঙ্কট
২০১৮ সালে মীমাংসিত বিষয়ে জারি করা পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে অহিদুল ইসলামসহ সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। সে রিটের শুনানি নিয়ে কেন ওই ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। অতঃপর, ২০২৪ সালের ৫ জুন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই পরিপত্র বাতিল করে রায় দেন। এরপর থেকেই মূলত ছাত্ররা আবারো সংগঠিত হয়। তারা কোটা সংস্কারের দাবিতে আবার আন্দোলন শুরু করে। এ অবস্থায় আদালতের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আবেদনটির ওপর শুনানির জন্য ৪ জুলাই দিন নির্ধারণ করেন। চলমান আন্দোলনে ঢাকা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্লকেড নামে অবরোধ কর্মসূচি পালন শুরু করেন। আন্দোলন চলাকালীন সময়েই ১০ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করে। প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবরোধের কারণে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা স্থিমিত হয়ে আসে। দূরপাল্লার বাসগুলো আন্দোলনের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনের সাথে আদালতের কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করে শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে কোটা সমস্যার সমাধানে ২০১৮ সালের ন্যায় সরকারের নির্বাহী আদেশ বলে চূড়ান্ত সমাধান চান।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ১৩ জুলাই বগুড়া শহরের পৌর এডওয়ার্ড পার্কের শহীদ টিটু মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলেন; “কোটা সরকার পুনর্বহাল করেনি। সরকার বরং শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করেছিল। বাতিলের পর কোটাহীনভাবে সরকারি ও অন্যান্য চাকরিতে নিয়োগ হচ্ছে। হাইকোর্ট রায় দিয়েছে কোটা পুনর্বহালের জন্য। সুপ্রিম কোর্ট সেটি স্থগিত করেছে। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে বা বিচারাধীন বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তাহলে আদালত অবমাননা হবে। এসব বুঝেও যারা জনভোগান্তি ঘটাচ্ছেন, সেই ভোগান্তি যাতে না ঘটে, সে জন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর এবং আশা করব শিক্ষার্থীরা সুপ্রিম কোর্টের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে“।
আমি কোন আইন বিশেষজ্ঞ নই। তবে আইন বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন আলোচনা থেকে যেটা জেনেছি তাহলো; আদালতে বিচারাধীন কোন বিষয়ে যদি সরকার হস্তক্ষেপ করে বা কোন নির্বাহী আদেশ দেন তাহলে সেটা আদালত অবমাননা হয় এবং এই বিষয়টি তখন বিরোধী রাজনৈতিক দল বা দেশের সুশীল সমাজ আদালতের উপর সরকার হস্তক্ষেপ করছে বলে সমালোচনা শুরু করেন। আমি মনে করি এখানে সরকার ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারি ছাত্ররাতো প্রতিপক্ষ নয় বরং এক পক্ষ। সে হিসেবে আন্দোলনকারিদের উচিৎ ছিলো আদালতের রায়কে সম্মান দেখিয়ে চার সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করা।
১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। দাবীগুলি মেনে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ২৪ ঘন্টা সময় বেঁধে দেন। সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমে জেনেছি যে,মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ বিষয়টি নিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি সংস্থা ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছেন।
আন্দোলনরত ছাত্রদের দাবি
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেন,‘আমরা ঈদের আগে এটর্নি জেনারেলের কাছে একটি আবেদন করেছিলাম। আমাদের দাবি মূলত তিনটি, ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কোটা রেখে কোটা পুনর্বণ্টন বা সংস্কার; চাকরির পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা ও কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া; এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। এই দাবিগুলির বর্তমান রূপ হলো; সরকারি চাকরিতে কার্যকর বর্তমান কোটা পদ্ধতি বাতিল; অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ন্যায্য হারে কোটা প্রদান করা; ও কোটা সর্বোচ্চ ৫% পর্যায়ে নামিয়ে সংসদে নতুন আইন পাস করা।
বিতর্কের জন্ম
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই ২০২৪ তারিখে কোটা নিয়ে গণভবনে বলেন; “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা না পেলে, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না? অপরাধটা কী?” (উইকিপিডিয়া)
২০১৮ সালে কোটাবিরোধী সংস্কার আন্দোলনের সময় সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন,‘ছাত্ররা কোটা ব্যবস্থা চায় না। তারা আন্দোলন করেছে। ফলে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে আর আলোচনা করার বা হা-হুতাশ করার কিছু নেই। আমি বলে দিয়েছি থাকবে না।’ (যায়যায় দিন, ১ জুলাই ২০২৪)
এই দুইটি বক্তব্যের মধ্যে কোথায় যেন একটা খটকা মনে হচ্ছে। তবে আমি প্রধানমন্ত্রীর ১৪ জুলাই ২০২৪ তারিখের বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত। স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্বাপরাধী, রাজাকারদের বংশধরেরা এই বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় কোন সুযোগসুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের প্রতি একটা আবেগ এবং রাজাকারদের নাতি-পুতিদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিলো। অবশ্যই, এটা আমারও হয়। কিন্তু এই বক্তব্য আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করেছে। তারা মনে করছে প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে সবাইকে রাজাকার বলেছেন। আমার মনে হয় বিষয়টি এমন নয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বেঁধে দেয়া ২৪ ঘন্টার আলটিমেটাম শেষ না হতেই প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, শিক্ষার্থীরা ব্যাঙ্গ করে মধ্য রাতে সমস্ত বাংলাদেশে একই সময়ে "তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? সরকার, সরকার" এবং "চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার" স্লোগান ব্যবহার করা শুরু করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মনে করেন, আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্য অপমানজনক। তারা ১৫ জুলাই সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম।
পূর্ব ঘোষণা অনুয়ায়ী ১৫ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে ঢাবির বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন। এর সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে এলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তারা বললো, কোনো বিক্ষোভকারী এই স্লোগান ব্যবহার করলে তাকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি পাকিস্তানে পাঠানো হবে। সংগঠনটি বলে যে বিক্ষোভকারীরা স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চেতনাকে আঘাত করেছে এবং ১৫ জুলাইয়ের পরে যাতে তাদের দেখা না যায়। এই স্লোগানগুলোর ব্যবহার বন্ধ না হলে তারা বিক্ষোভ করার ঘোষণা দেয়। এভাবেই শুরু হলো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এখানে একটা বিষয়ে লক্ষনীয় তাহলো; সাধারণ ছাত্রদের কোন আন্দোলন হলেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কোন না কোন ভাবে এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তখন আন্দোলন হয়ে যায় সাধারণ ছাত্র বনাম ছাত্রলীগ। যার ফলস্বরুপ দেখতে পেলাম পুলিশ সাংবাদিকসহ আহত তিন শতাধিক। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর এই আক্রমন যা একবারেই অনাকাঙ্খিত। যেটা ২০১৮ সালেও হয়েছিলো। বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী দীপু মনি বলেন; “যারা নিজেদেরকে রাজাকার বলে পরিচয় দেয়, তাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তস্নাত লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বা সে পতাকা কপালে বেঁধে নিয়ে মিছিল করবার কোনো অধিকার থাকতে পারে না”। এই ঘটনাগুলোর কারণে প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভকারীদের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তাদের আচরণকে "অত্যন্ত দুঃখজনক" বলে অভিহিত করেন। (উইকিপিডিয়া)
পর্যবেক্ষণ ও মতামত
২০১৮ সালের মীমাংসিত বিষয়টি পুনরায় আদালতে উত্থাপন আন্দোলনের পুনর্জন্ম দেয়। আপিল বিভাগের চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থাকে উপেক্ষা করে ছাত্রদের আন্দোলন না করে বরং অপেক্ষা করা দরকার ছিলো। যদি দাবি আদায় না হয় তাহলে আন্দোলন আবার শুরু করলে ভালো হতো। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য যেটাকে সাধারণ ছাত্ররা বুঝে হোক না বুঝে হোক তাদেরকে পরোক্ষভাবে রাজাকার বলেছেন বলে অভিহিত করছে সেটিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ ছিলো ব্যাখ্যা দিয়ে পরিস্কার করা। যেটা না করার ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যাঙ্গ করে "তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? সরকার, সরকার" এবং "চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার" এই শ্লোগানগুলোর জন্ম দিলো যা খুবই আপত্তিকর এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। যতোগুলো ভিডিও দেখলাম (আরো থাকতে পারে) সেগুলোতে শুধু এটাই শোনা যায়; "তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। এটা একেবারেই ক্ষমার যোগ্য নয়। যার ফলে সাধারণ ছাত্রদের একটা যৌক্তিক দাবির আন্দোলনে রাজনৈতিক ছাপ পড়ে গেলো। এখনতো প্রশ্ন উঠছে আদৌ সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে সওয়ার হয়ে সরকার বিরোধীরা কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছে কি-না? এর কারণে আন্দোলনের ফলাফল কতোখানি আদায় হবে তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেলো।
লেখক-কবি,উন্নয়ন গবেষক,