মঙ্গলবার, অক্টোবর ১৫, ২০২৪

ক্ষেপণাস্ত্রের আবিষ্কারক : টিপু সুলতান

  • সুমন পালিত
  • ২০২৪-০৪-১৯ ২০:৫৬:২৮

টিপু সুলতান কোন দেশের সুলতান? এমন প্রশ্নে হাজার, লাখ শুধু নয়, কোটি মানুষ বলবেন মহিশুরের সুলতান। তবে এ জবাবের মধ্যে রয়েছে মস্ত এক ভুল। টিপু কিংবা তার বাবা হায়দার আলী মহিশুরের সুলতান ছিলেন না, এটি এক ঐতিহাসিক সত্যি। তবে স্বীকার করতেই হবে মহিশুরের সুলতান না হলেও তারা আপন যোগ্যতায় হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। হায়দার আলী ও তার পুত্র টিপু সুলতানের কারণে দক্ষিণ ভারতের অতি ক্ষুদ্র রাজ্য মহিশুর ইতিহাসে মহিরুহ হয়ে ওঠে। গত আড়াই হাজার বছরে ভারতবর্ষে অনেক রাজা, বাদশাহ, সুলতান সম্রাট শাসক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। ইতিহাসের পাতায় কম বেশি তাদের নাম থাকলেও কালের বিবর্তনে মানুষের হৃদয় রাজ্যে এখনো জিইয়ে আছে মাত্র দুটি নাম। তাদের একজন মহামতি সম্রাট অশোক। আরেকজন টিপু সুলতান। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয় বিশ্বপরিসরেও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় তাদের নাম। আধুনিক যুগে দুনিয়াজুড়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সম্রাট অশোকের পঞ্চশীলা নীতির অনুসরণে। আর টিপু সুলতান? ভারতের কর্নাটক রাজ্যের মুসলমানরা তার নাম উচ্চারণ করেন হজরত টিপু সুলতান বলে। হিন্দুদের কাছেও তিনি এক অতি শ্রদ্ধেয় নাম। ভারতবর্ষে ইংরেজরা একমাত্র পরাজিত হয়েছে টিপু এবং তার বাবা হায়দার আলীর কাছে। তারাই টিপু সুলতানকে শের-ই-মহিশুর নামে অভিহিত করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসায় রয়েছে টিপু সুলতানের ভাস্কর্য। কারণ এই মহাবীর ছিলেন যুদ্ধে ‘ক্ষেপণাস্ত্র’ ব্যবহারের উদ্ভাবক।
টিপু সুলতান এবং তার বাবা হায়দার আলী চার দশক ধরে ভারতের কর্নাটকের মহিশুর রাজ্যের ভাগ্য বিধাতার ভূমিকা পালন করেছেন। ক্ষুদ্র রাজ্য থেকে মহিশুর পরিণত হয়েছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজ্যে। খাতাপত্রে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে কায়েম ছিল মুঘল শাসন। দিল্লির মুঘল সম্রাটের নামেই শাসিত হতো গোটা ভারত। তবে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাসহ ভারতের বিরাট অংশজুড়ে ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য। শেষ দিকের সব মুঘল সম্রাট ছিলেন ঠুঁটো জগন্নাথ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৃত্তিভোগী।
মুঘল আমলে টিপু সুলতানের পূর্ব পুরুষদের আগমন ভারতবর্ষে। যুদ্ধ ছিল তাদের পেশা। এদেরই একজন ফতে মোহাম্মদ। ক্ষুদ্র রাজ্য সিরার নবাবের দরবারে উচ্চপদে তিনি অধিষ্ঠিত হন। নবাবের সবচেয়ে পছন্দের লোক হয়ে ওঠায় অন্যদের ঈর্ষার পাত্র ছিলেন তিনি। সিরার নবাব হঠাৎ মারা গেলে উত্তরাধিকারের সংঘাত দানা বেঁধে ওঠে। এ সুযোগে প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হন ফতে মোহাম্মদ। রোজার সময় ঘটে এ হত্যাকাণ্ড। ফতের স্ত্রী মাজেদা বেগম ইফতার সাজিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন স্বামী কখন ফিরবেন। ঘাতকরা ফতে মোহাম্মদের লাশ বাড়ির আঙিনায় ফেলে যায় মাগরিবের আজানের ঠিক আগে। প্রতিহিংসার পরকাষ্ঠা দেখিয়ে ফতের দুই পুত্র শাহবাজ ও হায়দার আলীকে ধরে নিয়ে যায়। মাজেদা বেগমকে বলে যায় মুক্তিপণ না দিলে দুই পুত্রকে বিক্রি করা হবে দাস বাজারে।
স্বামী হারানোর শোকের চেয়েও দুই পুত্রকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন মাজেদা বেগম। কীভাবে মুক্তিপণ দিয়ে দুই পুত্রকে ফিরিয়ে আনবেন এটি তার পণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ছুটে যান মহিশুরের রাজ দরবারে। মহারাজ দোদ্ধা কৃষ্ণ রাজাইয়া ওয়াদিয়ার মন মাজেদা বেগমের আকুতিতে বিগলিত হয়। তিনি শাহবাজ ও হায়দার আলীকে মুক্তিপণ দিয়ে কিনে আনেন। দুই ভাই এবং তাদের বিধবা মাকে আশ্রয়ও দেন। শাহবাজকে দেওয়া হয় সেনাবাহিনীতে চাকরি। হায়দার আলী থাকেন ভাইয়ের ছায়া সঙ্গী হয়ে। অভিজাত পরিবারের সন্তান হলেও হায়দার আলীর ভাগ্য বিড়ম্বনায় পড়াশোনার সুযোগ পাননি। হঠাৎ মারা গেলেন মহিশুরের মহারাজ কৃষ্ণ রাজাইয়া। তার ভাই মহারাজ ইম্মাদির দুর্বলতার সুযোগে রাজ্য শাসনের ক্ষমতা চলে যায় প্রধানমন্ত্রী দেব রাজাইয়া ও প্রধান সেনাপতি নানজা রাজাইয়ার হাতে। শেষোক্ত জন হন রাজ্যের প্রধান নির্বাহী।
ভাগ্য বিড়ম্বনায় লেখাপড়ার সুযোগ না হলেও হায়দার আলী সাহসী সৈনিক হিসেবে পরিচিতি গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন একদিকে দূরদর্শী অন্যদিকে নেতৃত্বগুণের অধিকারী। ইতোমধ্যে দক্ষিণ ভারতজুড়ে দেখা দেয় অশান্তি। একের পর এক যুদ্ধ ও হানাহানি। হায়দার আলী বিভিন্ন যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের পরিচয় দিয়ে মহারাজ ইম্মাদি কৃষ্ণ রাজাইয়া ও প্রধান নির্বাহী নানজারাজাইয়ার দৃষ্টি কাড়েন। ক্রমান্বয়ে সাধারণ সৈনিক থেকে সেনাপতি ও পরবর্তীতে প্রধান সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। মহারাজ তাকে ‘নবাব বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করেন।
হায়দার আলী ছিলেন মহিশুরের রাজপরিবারের প্রতি অনুগত। কারণ তাদের দয়ায় তিনি ও তার বড় ভাই ক্রীতদাসের জীবন থেকে মুক্তি পান। ফলে নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেন মহিশুর তথা রাজপরিবারের সেবায়। মহারাজ ইম্মাদির কাছ থেকে রাজ্য শাসনের ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন যে দেব রাজাইয়া ও তার ভাই নানাজারাজাইয়া তারা ছিলেন দুর্নীতিবাজ। এক পর্যায়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দেবরাজাইয়াকে হটিয়ে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন নানাজারাইজাইয়া। হয়ে ওঠেন আরো স্বেচ্ছাচারী।
ইতোমধ্যে হায়দারাবাদের নিজাম ও মহারাষ্ট্রের মারাঠাদের আক্রমণ অর্থের বিনিময়ে ঠেকাতে প্রায় শূন্য হয়ে যায় মহিশুরের রাজকোষ। রাজপরিবারের বধূ ও রাজকন্যাদের গহনাতেও হাত দিতে হয়। প্রধান নির্বাহী নানাজারাজাইয়া তার ক্ষমতার দাপট দেখাতে রাজপ্রাসাদে ঢুকে মহারাজকেও অপমান করেন। তার এই ধৃষ্টতায় ফুঁসে ওঠেন প্রধান সেনাপতি হায়দার আলী। ১৭৬১ সালে তিনি মহিশুরের মর্যাদা রক্ষায় প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন। মহিশুর পা দেয় ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ে। সে অধ্যায় মহিশুরকে সত্যিকারের স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করার। দক্ষিণ ভারত শুধু নয় পুরো ভারতবর্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে মহিশুরকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নও দেখতেন হায়দার আলী।
প্রধান নির্বাহী হিসেবে মহিশুরের সব ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হলেও হায়দার আলী রাজ্য শাসন করতেন মহারাজের নামে। রাজ পরিবারের প্রতি তার আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। তবে রাজমাতা লক্ষ্মীমম্মানী হায়দারের উত্থানকে কখনো ভালোভাবে নেননি। ভাগ্যের ফেরে হায়দার আলী এক সময় ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিলেন। তার সেই পরিচয়কে মনে রেখে রাজমাতা তাকে অবজ্ঞা করতেন। হায়দারের পতন ঘটাতে মারাঠা ও হায়দারাবাদের নিজাম এমনকি ইংরেজদের সঙ্গেও গোপনে যোগাযোগ রাখতেন।
যা হোক হায়দার আলী ছিলেন নিঃসন্তান। প্রথম স্ত্রী বাধ্য হয়ে স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে দেন। কিন্তু কয়েক বছর কেটে গেলেও দ্বিতীয় স্ত্রী ফাতেমাও তাকে সন্তান উপহার দিতে পারেননি। একদিন স্বপ্ন দেখে ফাতেমা দরবেশ টিপু মাস্তানের দরবারে যান। সেখানে সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেন। বলেন তার ছেলে হলে তিনি তাঁকে আল্লাহর পথে দেবেন। দরবেশের দরবারে করা দোয়া বৃথা যায়নি। অচিরেই সন্তান সম্ভবা হন হায়দার আলীর দ্বিতীয় স্ত্রী। ১৭৪৯ সালে জন্ম নেয় পুত্র সন্তান। দরবেশের নামে তার নাম রাখেন টিপু সলতান। কানাড়ি ভাষায় টিপু শব্দের অর্থ বাঘ। টিপু সুলতান মানে বাঘদের সুলতান।
হায়দার আলী ১৭৬১ সালে মহিশুরের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। মহিশুরকে ভারতবর্ষের সেরা শক্তিতে পরিণত করার বাসনা তিনি পোষণ করতেন। অথচ সময়টা ছিল কঠিন সমীকরণে ভরা। মারাঠারা সে সময় অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি। ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ছাড়া যখন ইচ্ছা তখন যে কোনো জনপদে হামলে পড়ত মারাঠা সৈন্যরা। তস্করের মতো ছিল তাদের আচরণ। মহিশুরের প্রতিবেশী হায়দারাবাদের নিজাম মুঘলদের পতনের যুগে মারাঠাদের মতো আরেক শক্তিশালী পক্ষ হয়ে ওঠেন।
ইংরেজরা হায়দার আলীর দিকে দৃষ্টি রাখছিল মহিশুরের ভাগ্য বিধাতা হিসেবে তার আবির্ভাবের পর থেকেই। মারাঠা এবং হায়দারাবাদের নিজামকে নিয়ে তারা অভিযান চালায় মহিশুরের বিরুদ্ধে। ১৭৬৯ সালে শুরু হয় প্রথম মহিশুর যুদ্ধ। হায়দার বেছে নেন কাঁটা দিয়ে কাটা তোলার নীতি। মারাঠাদের কাছে দূত পাঠিয়ে মহিশুরবিরোধী অভিযান থেকে তাদের সরে যেতে রাজি করান। আর হায়দারাবাদের নিজামকে কৌশলে নিজের পক্ষে আনেন। হায়দার আলীর পতন ঘটাতে গিয়ে নিজেরাই বিপাকে পড়ে ইংরেজরা। হায়দারের দ্বারা পর্যুদস্ত হয়ে তারা লেজ গুটিয়ে মাদ্রাজে পালায়। যৌথ বাহিনী মাদ্রাজ অবরোধ করলে অপমানজনক শর্তে ইংরেজরা সন্ধি করতে বাধ্য হয়। প্রতিশ্রুতি দেয় তারা আর কখনও মহিশুরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে না। মহিশুর আক্রান্ত হলে বন্ধু হিসেবে পাশে থাকবে। ইংরেজরা হায়দার আলীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মর্যাদা দেয়নি। মারাঠাদের দ্বারা মহিশুর আক্রান্ত হলে তারা হায়দারের পাশে দাঁড়ায়নি। বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিতে ১৭৮০ সালে হায়দার আলী ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশীয় সব শক্তিকে জোটবদ্ধ করেন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন ইংরেজদের বিভিন্ন অবস্থানে তারা একই সঙ্গে হামলা চালিয়ে তাদের পরাস্ত করবেন। হায়দার আলী তার সৈন্য নিয়ে আঘাত হানবেন কর্নাটক ও মাদ্রাজে। মারাঠারা মুম্বাই ও তার আশপাশের ইংরেজ দুর্গগুলো দখল করবে। ভোসলে ও সিদ্ধিয়া বাংলায় ইংরেজ আধিপত্যে আঘাত হানবে এবং নিজাম উত্তর সরকার এলাকা দখল করবেন। হায়দার আলী আর্কট দখল করেন। ইংরেজরা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা মাদ্রাজে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ইতোমধ্যে ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জোটে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয়। মিত্ররা এগিয়ে না আসায় মাদ্রাজ দখলের চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন হায়দার আলী। ইংরেজরা মারাঠাদের সঙ্গে তাদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলে এবং নিজামকেও দলে টানে। ফলে হায়দার একা হয়ে পড়েন। ত্রিনোমালি ও পের্টোনোভোর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে তাকে বিপাকে পড়তে হয়। তবে ইতোমধ্যে সাফ্রেনের নেতৃত্বে ফরাসি নৌবহর দাক্ষিণাত্যে পৌঁছলে মহিশুর বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পায়। পাল্টা আঘাত হানার আগেই হায়দার আলী ক্যান্সারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মারা যান।
১৭৮২ সালে ৩১ বছর বয়সে মহিশুরের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন টিপু সলতান। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন তিনি। বছর না ঘুরতেই ১৭৮৩ সালে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে ইংরেজ ও ফরাসিরা তাদের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায়। তার পরও একা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান টিপু সুলতান। লাগাতার যুদ্ধে ক্লান্ত ইংরেজরা ১৭৮৪ সালে ম্যাঙ্গালোরে টিপুর সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ওই সন্ধিকে ‘অপমানজনক শান্তি’ বলে অভিহিত করেন। চুক্তি অনুসারে উভয়পক্ষ তাদের দখলকৃত এলাকা ফেরত দেয়। এ সন্ধির মাধ্যমে দ্বিতীয় মহিশুর যুদ্ধের অবসান ঘটে।
ম্যাঙ্গালোরে সন্ধি ছিল প্রকৃতপক্ষে সাময়িক যুদ্ধ বিরতির চুক্তি। এ সন্ধি চুক্তির পর দুই পক্ষই পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। ফরাসিদের সঙ্গে টিপু সুলতানের সখ্য, বিশেষত নেপোলিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ ইংরেজদের উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে হায়দারাবাদের নিজামের সঙ্গে ইংরেজদের সামরিক চুক্তি টিপু সুলতানকে নাখোশ করে। ১৭৯০ সালে ইংরেজদের মিত্র রাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করে টিপু সুলতান তৃতীয় ইঙ্গ-মহিশুর যুদ্ধের সূত্রপাত করেন। এ যুদ্ধ চলে ১৭৯০ থেকে ১৭৯২ সাল পর্যন্ত। মারাঠা ও হায়দারাবাদের নিজামের সঙ্গে ইংরেজদের জোট থাকা অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়ানো টিপু সুলতানের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। ইংরেজ, মারাঠা ও নিজামের সম্মিলিত শক্তিকে দুই বছর ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ্য হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ইংরেজদের নেতৃত্বাধীন ত্রিশক্তির জোট মহিশুরের রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অবরোধ করলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন টিপু সুলতান। ১৭৯২ সালে তিনি ত্রিশক্তির সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন। এ সন্ধি অনুসারে টিপু ত্রিশক্তিকে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ও নিজ রাজ্যের অর্ধেক তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ক্ষতিপূরণের টাকার জামিন হিসেবে নিজের দুই পুত্রকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেন টিপু সুলতান।
শ্রী রঙ্গপত্তমের সন্ধি ছিল টিপু সুলতানের জন্য অপমানজনক। তার পরও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর লর্ড কর্নলিয়াস কেন মহিশুর দখলের সুবর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা না করে সন্ধি চুক্তি করেন তা নিয়ে সমালোচিত হন। ইংরেজ, মারাঠা ও নিজাম বাহিনী টিপু সুলতানের রাজধানী অবরোধ করলেও তাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে পারেনি। যুদ্ধ আর কিছু দিন চললে গ্রীষ্মকাল এসে যেত আর সে সময়ে ইংরেজ সৈন্যদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা হ্রাস পেত। দ্বিতীয়ত, টিপু সুলতানের পক্ষে ফরাসিরা অস্ত্র ধারণ করলে যুদ্ধের গতি হয়তো তার পক্ষে চলে যেত। লর্ড কর্নালিয়াস সে ঝুঁকি নিতে চাননি।
শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি টিপু সুলতানকে কঠিন অবস্থার মুখে ঠেলে দেয়। রাজ্যের অর্ধেক চলে যায় শত্রুপক্ষের দখলে। ক্ষতিপূরণের অর্থ জোগাতে গিয়ে মহিশুরের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। চারদিক থেকে শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়ায় নিরাপত্তাগত সমস্যার সম্মুখীন হয় মহিশুর। টিপু সুলতান মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে তৃতীয় ইঙ্গ মহিশুর যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী সুসংহত করার উদ্যোগ নেন। তিনি ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কাবুল, আরব, মরিশাস এবং ওসমানিয়া খলিফার কাছে দূত পাঠান। ফ্রান্সের স্বেচ্ছাসেবকদের তিনি মহিশুরে নিয়ে আসেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। ১৭৯৯ সালের জানুয়ারিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন গভর্নর লর্ড ওয়েলেসলি সব দেশীয় রাজ্যের কাছে অধীনতামূলক মিত্রতার প্রস্তাব পাঠান। টিপু এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরিণতিতে ইংরেজ ও নিজামের যৌথ বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয় মহিশুর। সদাশির ও মালভেরির যুদ্ধে টিপু সুলতান হেরে যান যৌথ বাহিনীর কাছে। ইংরেজ ও নিজাম বাহিনী রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অবরোধ করলে টিপু সুলতান শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। টিপুকে প্রাণ হারাতে হয় বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন তার প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়। শুধু বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা রাহুগ্রস্ত হয়। ইংরেজ ও নিজাম বাহিনী মহিশুরের রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অবরোধ করলে টিপুর সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকতায় শত্রু বাহিনী দুর্গের দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে। টিপু সুলতান ছিলেন সে সময় মসজিদে। অতর্কিতে সেখানে পৌঁছায় শত্রু বাহিনী। টিপু সুলতান পালানোর সুযোগ পেয়েও না পালিয়ে একা তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইংরেজ বাহিনীর ওপর। ডান হাতে তরবারির দুটি কোপ পড়ার পরও তিনি এক অসম যুদ্ধে লড়তে থাকেন শত্রুদের সঙ্গে। এক পর্যায়ে রক্ত ক্ষরণে ঢলে পড়েন। আর সে সময়ে একজন ইংরেজ সৈন্য গুলি চালিয়ে হত্যা করে টিপু সুলতানকে। মীরজাফর সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার এনাম হিসেবে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি ছিলেন পুতুল নবাব। মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার ভোগ করার সুযোগ পাননি। যুদ্ধ ক্ষেত্রেই তাকে প্রাণ হারাতে হয় ।


এ জাতীয় আরো খবর