সাইকোলজির মূল বিষয়গুলোর মধ্যে সাইকোঅ্যানালাইসিস অন্যতম। ফ্রয়েড থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য মনোবিজ্ঞানীদের অবদানে আজ সাইকোঅ্যানালাইসিসকে কাজে লাগানো হচ্ছে অপরাধী ধরা থেকে শুরু করে চিকিৎসা করা পর্যন্ত। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরই মধ্যে সাইকোঅ্যানালাইসিসের একটা পৃথক ভাগ নিয়ে উঠেছে ফেমিনিন সাইকোলজি। ব্যাপারটা নিয়ে শুরুর দিকে বেশ আপত্তি থাকলেও বর্তমানে সবাই একমত, যে নারীদের পরিপূর্ণ মনঃসমীক্ষণের জন্যে একটি পৃথক শাখার বিকল্প নেই।
প্রথম কথা হচ্ছে, মেয়েদের সাইকোলজি নিয়ে এভাবে আলাদা বিস্তৃত গবেষণার কারণ কি? কারণটা খুব সহজ, মেয়েদের মধ্যে জেনারেল সাইকোলজির বাইরে কিছু ব্যতিক্রমধর্মী সাইকোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেগুলো অন্য কোন শাখার মধ্যে পড়েনা, আবার অ্যাবনরমাল সাইকোলজিও নয়। তাই নারীসুলভ কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে গড়ে উঠেছে ফেমিনিন সাইকোলজি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, যে মেয়েদের জন্যে বিশেষভাবে গাইনী ডাক্তার আছে, ছেলেদের জন্যে নেই। এর কারণ ছেলেদের বেশিরভাগ রোগই সাধারণ ডাক্তারির মধ্যে পড়ে।
মেয়েদের মধ্যে একটা সহজাত ব্যক্তিত্ত্ব থাকে, যা তাদের সৌন্দর্য্যের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ফেমিনিন সাইকোলজির একটা বড় অংশই এই ব্যক্তিত্ব সত্তাটা নিয়ে, যা মূলত তাদের সম্পূর্ণ নারী জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। পৌরুষের ব্যক্তিত্ব বলতে যা বোঝায়, এর ধরন তা থেকে একদমই আলাদা। একজন পুরুষ যেমন মাতৃত্বের অনুভূতি সম্বন্ধে কখনো ধারণা করতে পারবেনা, তেমনি এই নারীসত্তা সম্বন্ধেও কখনো স্পষ্ট ধারণা করতে পারবে না।
নারীদের এই নিজস্ব ব্যক্তিত্বের কথা সর্বপ্রথম বলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তাঁর মতে, এর জন্ম নারী শিশুর জন্মের ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে, ইডিপাস কমপ্লেক্স থেকে। সাধারণত মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে এই কমপ্লেক্সের তীব্রতা ছেলেদের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
এটা স্বাভাবিক যে তুলনামূলক সুন্দর, গোলগাল, নাদুস-নুদুস বাচ্চাদের সবাই একটু বেশি আদর করে, প্রশংসা করে। সাধারণত একটা সুন্দরী মেয়ে ৯ থেকে ১০ বছরের দিকে সচেতনভাবে বুঝতে পারে যে সমাজের কাছে তার কদর অন্য দশটা মেয়ের চেয়ে বেশি। যে মেয়ে যতো সুন্দরী, তার মধ্যে এই বোধ ততো দ্রুত এবং ততো তীব্রভাবে আসে। এই বোধটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটারই পরিপূর্ণ রূপ হচ্ছে আমরা যার কথা বলছিলাম, সেই নারীসত্তা।
এখানে একটা কথা বলা দরকার, যে সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্নরকম। কিন্তু সাইকোলঅ্যানালাইসিসের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই সাইকোলজিতে সৌন্দর্য্যের একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে। সেটা হচ্ছে, কোন মানুষ যদি নিজেকে ভাবে “আমি সুন্দর”, তবেই সে সুন্দর। কার কাছে ভালো লাগলো কার কাছে লাগলো না সেটা কোন কথা না, যদি তার নিজেকে ভালো লাগে। নিজেকে সুন্দর ভাবার কারণে তার মধ্যে সৌন্দর্য্যজনিত আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য তৈরী হয়, যা তার ব্যক্তিত্বে প্রচুর প্রভাব ফেলে। তবে বলা বাহুল্য, সমাজের বড় একটা অংশ কাউকে সুন্দর বলে মতামত দিলে তবেই তার মধ্যে “আমি সুন্দর” এই বোধটা তৈরী হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে পিগমিদের কথা। আফ্রিকার বিশেষ একদল পিগমিদের মধ্যে প্রতি বছর একজন সেরা সুন্দরী বিবেচনা করে গ্রামের সর্দারের সেবায় পাঠানো হয়। তাদের সেই সুন্দরীর চেহারা দেখলে আমাদের পক্ষে ভিরমি খাওয়া অস্বাভাবিক নয়। অর্থাৎ, কোন একটি মানুষ সুন্দর কিনা নির্ধারণ করবে তার সমাজ, কিন্তু ঐ সৌন্দর্য্য তখনি ঐ মানুষটির সাইকোলজিতে প্রভাব ফেলবে যখন সে তার সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে সচেতন হবে। ফ্রয়েডের ভাষায়, তার চেতন ও অবচেতন মন তাকে সুন্দর হিসেবে ঘোষণা করবে।
একটি সুন্দরী মেয়ে যখন ধীরে ধীরে তার এই সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে সচেতন হয়, তখন তার মধ্যে বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয়। সে যখন সাবালিকা হয়, তখন সাধারণত তার ব্রেন থেকে মূল ফিমেল হরমোন ইস্ট্রোজেনের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। এবং এই বৃদ্ধির পরিমাণ তার সৌন্দর্য্যের উপর নির্ভর করে। বিশেষ করে যেসব মেয়ে নিজেদের অত্যধিক সুন্দরী বলে মনে করে, তাদের ক্ষেত্রে এই হরমোনের নিঃসরণ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চারগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এবং এক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনের প্রভাব দেখা যায় খুব সরাসরি। তার শরীর-স্বাস্থ্য আরও সুগঠিত হয়ে ওঠে, নারীসুলভ আচরণ বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। যে কারণে সমাজের চোখে, তথাপি তার চোখে সে আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। তখন প্রায়ই বিভিন্নজনকে বলতে শোনা যায়, “যতোই দিন যাচ্ছে মেয়েটা আরও সুন্দর হয়ে উঠছে!”
পুরো ব্যাপারটাকে ছক আকারে এভাবে দেখানো যায়-
ইডিপাস কমপ্লেক্স--> নারীত্বের বোধ--> সৌন্দর্য্যের বোধ-->
১. আমি সুন্দরী
২. আমি সুন্দরী নই
আমি সুন্দরী--> পরিবারের স্তুতি--> আমি বেশ সুন্দরী (ইস্ট্রোজেন নিঃসরণ বৃদ্ধি)--> নারীসুলভ শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি--> সমাজের স্তুতি--> আমি খুব সুন্দরী (ইস্ট্রোজেন নিঃসরণ বৃদ্ধি)--> নারীসুলভ শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি--> ছেলেদের স্তুতি--> আমি দারুণ সুন্দরী (ইস্ট্রোজেন নিঃসরণ বৃদ্ধি)--> নারীসুলভ শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি
এই চক্র থেকে দেখা যায়, সাধারণত ‘আমি সুন্দরী’ বোধটাই মেয়েদের আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার মূল কারণ, যা অনবরত প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এই বোধের কারণেই তাদের সৌন্দর্য্য পরিপূর্ণতা পায়, ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে নারীসুলভ আচরণ প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায় যা ছেলেদের আরও বেশি আকৃষ্ট করে।
সংকলিত