১৯৬৭ তে প্রতিষ্ঠিত অফিসার্স ক্লাব ঢাকা হাঁটিহাঁটি পা পা করে ইতোমধ্যেই কর্মমুখর ৫৬ টি বছর পার করছে। দোতলা একটি ভবন দিয়ে শুরু করে এখানে এখন একাধিক বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে সদস্যদের চাহিদা ও বর্তমান সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী। আজ এটি ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় ক্লাব যার সদস্য সংখ্যা প্রায় আট হাজার।
বর্তমানের চারতলা ভবনের উপর থেকে ক্লাবের সামনে অবস্থিত টেনিস কোর্ট গুলির দিকে তাকালে যে কারো মন জুড়িয়ে যাবে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই চমৎকার মিলনকেন্দ্র বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এর জন্য অবশ্যই একটি গৌরবের স্থান যা সারাদিনের ব্যস্ত সময়ের পর স্বাস্থ্য পরিচর্যা, বিনোদন ও ভালো মানের আপ্যায়নের জন্য সকল সদস্যদের কাছেই জনপ্রিয়।
ছেলেবেলায় দেখেছি এখানে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন লায়ন্স ও রোটারি ক্লাবের সভা অনুষ্ঠিত হতে। আমাদের মন জুড়িয়ে যেত সেসময়কার অফিসারদেরকে নিয়মিতভাবে টেনিস খেলতে দেখে। হয়তো নিজের মনের অগোচরেই তারুন্যের শুরুতেই এই ক্লাব আমাকে অফিসার হওয়ার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
বর্তমানে অফিসার্স ক্লাব প্রাঙ্গনে আরো বহু ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ঢাকা শহরের বড় বড় প্রাইভেট ক্লাবগুলোর সদস্যদের সাথে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিশেষ করে টেনিসের।
অফিসার্স ক্লাবের মহিলা অঙ্গনও খুবই সক্রিয়। সারা বছর ধরেই এখানে আয়োজিত হয় পিঠাসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার উৎসব, মহিলাদের পছন্দের জিনিসের প্রদর্শনী এবং আরও অনেক কর্মকান্ড যা বছর থেকে বছরে পরিবর্তিত হয়। এই ক্লাবের পিকনিক ও নৌ ভ্রমণ ঢাকা শহরে সর্বজন বিদিত।
সমাজকল্যাণমূলক কাজেও অফিসার্স ক্লাব পিছিয়ে নেই। প্রজাতন্ত্রের নির্বাহীদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হন এই সংস্থার সদস্যবৃন্দ ও তাদের পরিবার। শীতকালীন বস্ত্র বিতরণ থেকে শুরু করে বন্যাকালীন রিলিফ প্রদান এমনকি করোনার সময় প্রয়োজনীয় টিকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে এই ক্লাব।
এরই পাশাপাশি সদস্যদেরকে তাদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন করার জন্য নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ধরণের সেমিনারের আয়োজন এখানে করা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে হৃদরোগ, ক্যান্সার, বিভিন্ন ধরনের মরণব্যাধি সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে অবগত করা হয় আগ্রহী সদস্যদের।
অফিসার্স ক্লাবের বিশেষভাবে আকর্ষণীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি হলো সুইমিং পুল, যেখানে কিনা সময়ের সাথে পুলটির আধুনিকায়ন করা হয়েছে এবং এখানে রয়েছে সাঁতার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা।
অন্যদিকে তাস খেলায় আগ্রহী কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে একাধিক ধরনের খেলায় অংশ নেওয়ার বন্দোবস্ত, যেখানে কিনা প্রতিদিনই ভিড় লেগে থাকে। বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর এই মাধ্যমটি নিয়মিত ব্যবহারের মধ্য দিয়েই তাঁদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। এই ক্লাবের আরেকটি জনপ্রিয় বিনোদন হচ্ছে হাউজি খেলা।
বর্তমানে মূল ভবনের তিনতলায় অবস্থিত ক্যাফেটারিয়ার আকর্ষণও কোনো অংশে কম নয়। এখানে ভালোমানের বিভিন্ন ধরণের স্ন্যাক্স শহরের অন্যান্য জায়গার চেয়ে সুলভ মূল্যে পেয়ে থাকেন ক্লাবের সদস্যরা এবং তা মন ভরে উপভোগ করেন নিজ পরিবার ও বন্ধুদের সাথে। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই ভরা থাকে আমাদের ক্যাফেটারিয়া।
অফিসার্স ক্লাবের লাইব্রেরীও সময়ের সাথে নতুন নতুন প্রকাশনা সংগ্রহ করে হয়েছে সমৃদ্ধ। এখানে রাখা বহুল প্রচলিত জাতীয় দৈনিক গুলো পড়ার জন্য প্রতিদিনই নিয়মিতভাবে অনেকেই ভিড় জমান। এখানে উল্লেখ্য যে, টেনিসের পাশাপাশি অফিসার্স ক্লাবে রয়েছে ব্যাডমিন্টন, বিলিয়ার্ড, স্কোয়াশ, স্নুকার খেলার বন্দোবস্ত।
বর্তমানে যে বহুতল ভবনটি নির্মিত হচ্ছে তার কাজ সম্পন্ন হলে অফিসার্স ক্লাবের কর্ম পরিধি আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। নতুনভাবে চালু করা সাহিত্য পুরস্কারকে আরও মানসম্মত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি চালু হতে পারে সংস্কৃতি প্রতিযোগিতার।
বর্তমানে সিনিয়র (৬৫ ঊর্ধ্) সদস্যদের জন্য আলাদা করে কোন ক্লাব কর্নার কিংবা বিশেষ স্বাস্থ্য পরিচর্যার বন্দোবস্ত এই ক্লাবে এখনো গড়ে ওঠেনি। অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের কে বিবেচনায় নিয়ে তাদের পরামর্শক্রমে এ ব্যাপারে এখন থেকে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিশুকিশোরদের জন্যও তাদের মন মনন ও স্বাস্থ্য গঠনের উপযোগী বিশেষ কর্মকান্ড গ্রহণ করতে পারে অফিসার্স ক্লাব। এখানে থাকতে পারে নবীন কর্মকর্তাদের শিশুদের জন্য সান্ধ্যকালীন কেয়ার সেন্টার যেখানে শিশুদেরকে রেখে সদস্য পিতা-মাতারা নিজে অন্য কোন খেলায় মনোনিবেশ করতে পারবে।
প্রজাতন্ত্রের প্রয়োজনে বাংলাদেশের বহু কর্মকর্তা প্রতিবছরই স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণে বিদেশে যান, যাদের কিনা ভাষাগত ট্রেনিং দেয়ার ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে পারে অফিসার্স ক্লাব। এটি হতে পারে ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাস সমূহ, বিদেশি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায়। এখনকার দিনে বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও পেশাজীবি সকলেরই আরও একটি দুটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন কেননা এটি এখন সময়ের দাবি। ভাষার পরপরই নবীনদেরকে পেশাদার প্রশিক্ষকের সহায়তায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করতে পারে অফিসার্স ক্লাব। ভাষা ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দু'রকমই হতে পারে। সদস্যদের কৃতি সন্তানদেরকে মাধ্যমিক হতে পিএইচডি পর্যায় পর্যন্ত স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে।
নতুন বিল্ডিং এ আরো থাকতে পারে ঢাকার বাইরে থেকে স্বল্প দিনের জন্য আসা সদস্য কর্মকর্তার থাকার উপযোগী গেস্টরুমের বন্দোবস্ত। একই সাথে বন্ধু রাষ্ট্র সমূহের অফিসার্স ক্লাবদের সাথে ঢাকা অফিসার্স ক্লাব সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের আয়োজনে একে অপরকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর একাধিক দেশের প্রজাতন্ত্রের নির্বাহীদের নিজস্ব সঙ্গীত দল রয়েছে যারা নিজেদের মন্ত্রণালয়ের বাইরেও বিভিন্ন দেশে গান ও যন্ত্র সংগীত পরিবেশনা করে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে নতুন নতুন যে সব তথ্য ও উপাত্ত সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার উপরেও সদস্যদের জন্য বিশেষজ্ঞদের উপস্থাপনায় বছরে কয়েকটি সেমিনারের আয়োজন করতে পারে আমাদের ক্লাব। জাতীয় উৎসব ও ছয় ঋতুর বিভিন্ন দিন উদযাপনের পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত তথ্য সমৃদ্ধ করবে সদস্যদের মন ও মানসিকতাকে।
সবশেষে নির্ধারিত বেতনে জীবন যাপনকারী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহীদের জন্য সরকারের সহায়তা সাপেক্ষে অফিসার্স ক্লাবে বিভিন্ন পণ্যের এক বা একাধিক বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। যেখানে কিনা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যাবে সুলভ মূল্যে। বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সাথে এরকম একেকটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে যেখানে নিত্যদিনের চাহিদা মাফিক ভালো মানের বহু দ্রব্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন ক্লাব ঢাকা ক্লাবে রয়েছে উন্নত মানের বেকারি। অফিসার্স ক্লাব এই ব্যাপারে পিছিয়ে থাকবে কেন। কেবলমাত্র রোজার সময় নয়, সারা বছরব্যাপী বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার, কেক , বিস্কিট বিক্রির জন্য ক্লাবের একটি নিজস্ব বেকারি থাকা এখন সময়ের প্রয়োজন।
এখানে উল্লেখ করা যায় অন্যান্য দেশের এই ধরনের ক্লাবে উন্নত মানের লন্ড্রি এবং সেলুনের বন্দোবস্ত রয়েছে সদস্যদের ও তাদের পরিবারের জন্য।
বর্তমানের মূল ভবনের চতুর্থ তলার ছাদে নামাজ পড়ার বন্দোবস্ত হয়ে থাকে, যার একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করা প্রয়োজন একটি মসজিদ স্থাপনের মাধ্যমে।
আজকে যেখানে সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮ হাজারে পৌঁছেছে নতুন কমিটির সময় সুনিশ্চিত ভাবে বলা যায় সংখ্যাটি ১০ হাজারে পৌছাবে। কাজেই সারা বছরের বিয়ে, জন্মদিন ও অন্যান্য সামাজিক উৎসবগুলো উদযাপনের জন্য মিলনায়তন ভাড়া দেয়ার পাশাপাশি সদস্যদের জন্য আরও কি কি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এখনই চিন্তা করার সময়।
প্রাক্তন সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক পরামর্শক, এফবিসিসিআই