লায়লা আর্জুমান্দ বানু। কণ্ঠশিল্পী। নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, গজল, আধুনিক গান ও লোকসঙ্গীতের অসামান্য প্রতিভাবান এজ কণ্ঠশিল্পী তিনি। এমন এক সময় ছিল যখন পর্দা প্রথা মুসলিম নারীদেরকে ঘরের বাইরে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হতো। প্রবল বাধা-বিপত্তি আসতো নিজের ঘর থেকে, সমাজ থেকে। সেই সময়ে লায়লা আর্জুমান্দ বানু, সকল বাধা-নিষেধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বাংলার সংগীত, বাংলার সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। নিজে অর্জন করেছেন খ্যাতি। অর্জন করেছেন মানুষের ভালোবাসা। দেশবরেণ্য এই গুণী কণ্ঠশিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৯৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী, ৬৬ বছর বয়সে, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াত খ্যাতিমান কন্ঠশিল্পী লায়লা আর্জুমান্দ বানু'র স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত প্রার্থনা করি।
লায়লা আর্জুমান্দ বানু ১৯২৯ সালের ৫ জানুয়ারী, ঢাকার এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি সোনারগাঁ'র শাদীপুরে। পিতার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর (ইতিহাসবিদ-লেখক ) এবং মাতার নাম সৈয়দা সারা তৈফুর (লেখিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট মেম্বার, জেল ভিজিটর, পাকিস্তান ফিল্মস সেন্সর বোর্ডের সদস্য এবং ঢাকার রেডিওর ব্রডকাষ্টার ছিলেন )। তাঁর বড় বোন ঢাকা রেডিওর (অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্র) প্রথম বাঙ্গালী মুসলিম মহিলা নাট্যশিল্পী বেগম লুলু বিলকীস বানু। তিনি ঢাকা রেডিওর কেন্দ্রের সর্বপ্রথম বাঙ্গালী মুসলিম মহিলা কন্ঠশিল্পী। তাঁর ছোট বোন ঢাকা রেডিওর দ্বিতীয় বাংগালী মুসলিম মহিলা কন্ঠশিল্পী বেগম মালেকা পারভীন বানু।
সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ( চিত্রপরিচালক-প্রযোজক এবং চলচ্চিত্রবিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা "চিত্রালী"র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) তাঁর চাচাতো ভাই।
লায়লা আরজুমান্দ বানু ১৯৪৪ সালে, ইডেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৬ সালে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ এবং ১৯৫০ সালে ফারসি ও দর্শনশাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন ।
লায়লা আর্জুমান্দ বানু প্রথমে উচ্চাংগ সংগীত-এ শিক্ষা লাভ করেন পন্ডিত রমনী মোহন ভট্রাচার্য এবং ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খানের কাছে। ১০বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে ১৬ ডিসেম্বর ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিশু কন্ঠশিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করেন। সেদিন তিনি প্রথমে- "খেলার সাথী এসো এসো আমার খেলা ঘরে" গানটি সমবেত কন্ঠে এবং পরে- "নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি জল" গানটি একক কন্ঠে গাওয়ার মধ্যমে সংগীত জগতে পা রাখেন। এই গান দুটির গীতিকার যথাক্রমে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
তার গাওয়া ‘মোহাম্মদ মোর নয়নমণি’; ‘মুহররমের চাঁদ এলো ওই কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়’; ‘মসজিদে ওই শোনোরে আজান চলো না নামাজে চলো’; ‘খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে’; ‘সাহারাতে ফুটলরে ফুল’; ‘মোহাম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে’ প্রভৃতি গান সেই সময় ঢাকা বেতারে প্রায়শ বাজানো হতো, বহুল জনপ্রিয় গান হিসেবে ।
তিনি টেলিভিশনে গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৬৭ সালে ।
নজরুল গীতির বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত লায়লা আর্জুমান্দ বানু চলচ্চিত্রের গানেও কন্ঠ দিয়েছেন। চলচ্চিত্র কন্ঠশিল্পী হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি 'সাহুনী' (উর্দু)। তারপরে তিনি আরো কন্ঠ দেন- ‘কিসমৎ’ (উর্দু), 'এদেশ তোমার আমার', 'মাটির পাহাড়' 'সন্ধিক্ষণ' ও 'রংবাজ' ছবিতে।
ব্যক্তিজীবনে লায়লা আর্জুমান্দ বানু, প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব মোঃ শামসুল হুদা চৌধুরীর সংগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান ডঃ শাহনাজ হুদা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং চেয়ারম্যান)।
লায়লা আর্জুমান্দ বানু ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা সরকারী সংগীত মহাবিদ্যালয়ের অবৈতনিক অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ঢাকা জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি, নজরুল স্বরলিপি শুদ্ধীকরণ বোর্ড-এর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সংস্কৃতি কমিশনের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে প্রকাশিত ঢাকা পাস্ট প্রেজেন্ট ফিউচার-এর সংগঠনিক কমিটির সদস্য ছিলেন।
লায়লা আর্জুমান্দ বানু মূলত উচ্চাংগ সংগীত শিল্পী, কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, আধুনিক গান, গজল এবং লোকসংগীতের ক্ষেত্রে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করেন।
তিনি বাংলা, উর্দু , ফার্সি, তুর্কি এবং রুশ ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ধরনের সংগীত পরিবেশনে পারদর্শী ছিলেন।
তিনি ১৯৬৮ সালে ইরানের শাহ রেজা পাহলবীর নিকট থেকে ‘অভিষেক পদক’ এবং ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট হতে সম্মানজনক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ পুরস্কার গ্রহণ করেন।
লায়লা আর্জুমান্দ বানু শারীরিকভাবে চলে গেলেও, রয়েগেছে সংগীতের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিসম্পন্ন ও দেশবরেণ্য কন্ঠশিল্পী লায়লা আর্জুমান্দ বানু, সংগীত পিপাসু মানুষের মনে চিরজাগোরুক থাকবেন।