সোমবার, জানুয়ারী ১৩, ২০২৫

ফিরে আসা

  • সেলিম জাহান
  • ২০২৪-০১-২২ ২২:৫০:১৯

উনপঞ্চাশ  বছর আগের কথা- ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারী মাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ - সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে। দর্শকদের বসার আসনের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় বসে আমরা দু’জন আড্ডা দিচ্ছিলাম ওর পরবর্তী দৌড় প্রতিযোগিতার আগে। রৌদ্রজ্জ্বোল আকাশ, মৃদু বাতাস - একটি সুন্দর সকাল। একটু আগে ও দু’ঠোঙ্গা চানাচুর কিনেছে এক চানাচুর বিক্রেতাকে ডেকে। চানাচুর খাচ্ছি আর এলোমেলো গল্প করছি। ভারী সুন্দর আবহ একটা। 
হঠাৎ কি যে মনে হল। জিজ্ঞেস করলাম ওকে - আমার বন্ধু শেখ কামালকে, ‘আচ্ছা, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেঁচে ফিরে এলেন, তখন কি মনের মধ্যে কি হয়েছিল তোর?’ কামাল চুপ করে গেলো, তাকিয়ে রইল আনমনে সূদূরের দিকে। তারপর খুব নরম করে বললো, ‘ধর্, তোর কোন খুব প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলো। তুই আশা ছেড়ে দিয়েছিস সে জিনিসটির। কিন্তু হঠাৎ করে তোর কাছে সেটা আবার এলো - তখন অদ্ভুত এক ভালো লাগায় মন ভরে যায় না তোর? 

May be an image of 3 people and suit
কামাল ওর উজ্জ্বল পিঙ্গল চোখে এক লহমার তরে তাকায় আমার দিকে, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে মেডিক্যাল কলেজের সামনের উঁচু তেলসুর গাছের দিকে। চানাচুর মুখে পোরে এক মুঠ। আমি জবাব দেই না ওর প্রশ্নের, আকাশের দিকে তাকাই, চানাচুরের ঠোঙ্গাটা দলামোচা করি। একটি শান্ত নিশ্চুপতা দু’জনের মধ্যে,  আমি কিন্তু বুঝতে পারি কি চলছে ওর মনে। আমি আর কোনদিন এ প্রশ্ন করি নি ওকে, কামালও ঐ প্রসঙ্গ তোলে নি আর।
এ ঘটনার বছর তিনেক আগে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেছিলেন এই দিনে - ১০ জানুয়ারী, ১৯৭২। সে দিনের টুকরো টুকরো কত যে স্মৃতি গেঁথে আছে আমার  হৃদয়ে। মনে আছে, সাইপ্রাসে যাত্রা বিরতির সময়ে প্রশান্ত হাস্যেজ্জ্বল বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখেছিলাম। তারপর লন্ডনে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু ক্ল্যারিজ হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন, সে ছবির কথাও ভুলি নি। একটু ক্লান্ত তিনি - কিন্তু কি তাঁর দৃঢ়তা, কি তাঁর উদ্যম, কি তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত ভঙ্গী! তাঁর পাশে চিনতে পারি বিবিসির সিরাজুর রহমানকে। 
‘এই যাত্রা অন্ধকার থেকে আলোমুখী, বন্দীত্ব থেকে মুক্তির পথে, নির্জনতা থেকে আশার দিকে’ - বঙ্গবন্ধুর সেদিনের এ কথাগুলো কখনো আমি ভুলবো না। আমার নানান লেখায় আমি এ বাক্যটি ব্যবহার করেছি,  আমার একাধিক বক্তৃতায় এ শব্দমালা উঠে এসেছে এবং আমার ব্যক্তিগত জীবনের বহু ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধুর এ কথাক’টি আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। আমার বড় প্রিয় এ পংক্তি।

May be an image of 10 people and crowd
এখনও চোখ বুঁজলে সে ছবি দেখতে পাই - কি সম্মানের সঙ্গে, কি ভালবাসার সঙ্গে, একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় তাঁকে বরণ করে নেয়া হচ্ছে দিল্লী বিমানবন্দরে। ইন্দিরা গান্ধী তো ছিলেন,  সেই সঙ্গে ছবিতে দেখা যায় রাষ্ট্রপতি ভি.ভি গিরিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিংকে, ও পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে। যেহেতু ড: কামাল হোসেনও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তানী কারাগারে এবং পরের পথযাত্রায়, তাই প্রায় সব ছবিতেই তিনি ছিলেন উপস্হিত।
সেদিন ঢাকার বিকেলের কথা মনে আছে - সেই শীত-বিকেলের কথা। জনসমুদ্রের মধ্য দিয়ে প্রায় শম্বুক গতিতে এগুচ্ছিল বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী শকটটি।জনসমুদ্র ঠেলে সে শকটের যাত্রার ধারাবিবরণী দেয়া হচ্ছিল বাংলাদেশ বেতার থেকে। কি উদ্দীপ্ত সে বিবরণী - কি আবেগ তাতে, কি আশার বাণী! 
শকটের ওপরের সব মুখগুলোই চেনা। প্রথমেই আমার চোখ যায় শেষের সারিতে সামরিক পোশাক করা লেফট্যানেন্ট শেখ কামালের দিকে। অন্য দু’জনের দিকেও দৃষ্টি যায় - খোন্দকার মোশতাক আহমেদ আর কে এম ওবায়দুর রহমানের দিকে।১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টে ঐ দু’জনের ভূমিকা সম্পর্কে ইতিহাস জানে।
মনে আছে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানের জনসমুদ্রে ভাষন দিতে গিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কথা, মা-বোনদের ওপরে অত্যাচারের কথা, পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংশতার কথা। তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন সব বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের কাছে, যারা আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছিল, কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি। সেই আবেগমথিত ভাষণ কি করে ভুলি? 

May be an image of 2 people
আজ কামালের কথাগুলো বড় বেশী করে মনে পড়ে - ঐ কথা ক’টি ছিল একজন সন্তানের মমতার প্রকাশ একজন পিতার প্রতি, যে পিতা ঘরে ফিরবেন কিনা, তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। সেই সঙ্গে মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছিলেন, কিন্তু বাঙ্গালীদের হাত থেকে বাঁচতে পারেন নি। পাকিস্তানীরা তাদের শত্রু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নি, কিন্তু আমরা আমাদের পিতাকে হত্যা করেছি তাঁর ঘরে ফেরার সাড়ে তিন বছরের মাথায়।

 


এ জাতীয় আরো খবর