মন ভালো নেই রাশেদের। দাপ্তরিক কাজে আগের মতো আর মনোযোগ নেই। আগে দাপ্তরিক কোন কাজ হাতে এলে সোৎসাহে কাজটি সাথে সাথেই করে ফেলতো ও। এখন আর সেই উদ্যম নেই। গতকাল ওর প্রতিষ্ঠানের এদেশের চীফ শওকত সাহেব তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে ওর এমন অমনোযোগিতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাশেদ তার যথার্থ জবাব দিতে পারেনি। কী জবাব দিতে পারতো রাশেদ? সেই কথা কী আর বসের কাছে খুলে বলা যায়? বসের সামনে গিয়ে তাঁর গম্ভীর মুখটা দেখে ভড়কে গিয়ে কী বলতে গিয়ে কী বলেছিল রাশেদ তার কোন ঠিক নেই। আবোলতাবোল বলে বসের কাছে যাচ্ছে তাই ধমক খেয়েছিল। সেই অপমানের জ্বালায় ভেতরটা এখনও পুড়ছে ওর। কিন্তু কেন এমন হলো? আগে তো কখনও এমন ছিল না ও! ওর পারফরম্যান্স নিয়ে কেউ তো কখনো কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি?
একটা জিনিস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না রাশেদ। নীলা প্রায় প্রতিদিনই গোপনে ওর সাথে দেখা করছে। ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশছে। আড্ডা দিচ্ছে। ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওকে সাথে করে নিয়ে শপিং করছে। সিনেমা হলে গিয়ে দু'জনে মিলে সিনেমা দেখছে। রাশেদ জানে, নীলা ওকে পছন্দ করে। ভালোবাসে। না হলে ওর সাথে এমন ঘনিষ্ঠভাবে মিশবে কেন? রাতে বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে গোপনে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে জেগে পরস্পর পরস্পরের সাথে মোবাইল ফোনে ফিসফিসিয়ে কথা বলা আর হাসাহাসি না করলে ওদের চলেই না। আজকাল সেটি ওদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে? এতো কিছুর পরেও নীলা মুখ ফুটে কিছু বলছে না কেন? এনগেইজমেন্টের প্রসঙ্গ আনলেই ইচ্ছে করেই ও এড়িয়ে যাচ্ছে। এই বিয়েতে ওর সম্মতি আছে কিনা সেটি পরিষ্কার করেও কিছু বলছে না। কিন্তু এনগেইজমেন্টের মানেই তো আর বিয়ে নয়। হাতে একটা আংটি পরিয়ে দিলেই কী কোন নারী কারো বউ হয়ে যায়? নীলা বেশ ভালো করেই জানে এবং বোঝে রাশেদ মন প্রাণ দিয়েই ওকে ভালোবেসে। ওকেই চায়। তবে কেন সে এমন করে ওকে টেনশনের মধ্যে রেখেছে? কী চায় নীলা? ওর ইচ্ছেটা কী সেটি পরিষ্কার করে বলে দিলেই তো পারে! এভাবে অন্ধকারে রাখার তো কোন মানে হয় না। এই তো সেদিন দু'জনে লুকিয়ে মধুমিতা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখলো। কিন্তু সিনেমা দেখার চেয়ে রাশেদের হাতটা সারাক্ষণ পেঁচিয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখতেই বেশি মনোযোগী ছিল নীলা। রাশেদও ওর মাথার ঘন রেশমী কোমল চুলগুলোর উপরে আদরের হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। কই নীলা তো কিছু বলেনি? বাধা দেয়নি? অবশ্যি একবার একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল-এই যা।
আবার সেই দিনের কথা! যেদিন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে লোপা বৌদির গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। উলুখোলা, কালিগঞ্জ, গাজীপুরের খ্রিস্টান পল্লীর বাড়িতে। দীর্ঘ একটা পথ ভ্রমণ করেছিল ওরা। স্কুটারে চড়ে। পথে স্কুটারে ঘুমে কাতর হয়ে ঢলে পড়ছিলো নীলা ওর গায়ের উপরে। বারবার পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন আদর করে ওকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল রাশেদ। কী যে ভালো লাগছিল ওর! সেদিন নীলার পরনে ছিল কারুকাজ খচিত লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। পায়ে আলতা আর নূপুর পরা। আভরণে রাবীন্দ্রিক সাজসজ্জা। বাতাসে ওর রেশমী কোমল চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বারবার ওর মুখটা ঢেকে দিচ্ছিল। তা সরিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখটা গভীর ভাবে তাকিয়ে দেখেছিল রাশেদ। কপালে লাল রঙের টিপ পরেছিল নীলা। ঠোঁট জোড়াও লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে রাঙিয়ে ছিল সেদিন। কী সুন্দর লাগছিল ওকে! ঘুমন্ত মুখটা খুব আদুরে দেখাচ্ছিল। লোভ সামলে রাখতে পারেনি রাশেদ। এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে ওর তুলতুলে মসৃন গালে আলতো ভাবে একটা চুমু খেয়েছিল। কিছুই টের পায়নি নীলা। একটু নড়েচড়ে আবার ওর বুকের মধ্যেই ঘুমিয়ে ছিল। নাকি টের পেয়েছিল? এই ব্যাপারে নিশ্চিত নয় রাশেদ। টের পেয়ে থাকলেও ওকে তো কিছু বলেনি! তবে?
এসব বিষয়ের আশু সুরাহা হওয়া দরকার। ন্যাকামী আর একদম ভালো লাগছে না রাশেদের। আজ নীলা আবার আসছে ওর সাথে দেখা করতে। সেই ধানমন্ডি লেকে। আজ এলে কোন রকম রাখঢাক না করে সোজা সাপটা জিজ্ঞাসা করবে রাশেদ-নীলা ওকে চায় কী চায় না, ভালোবাসে কী বাসে না? এনগেইজমেন্ট ফিরিয়ে দিয়ে ওকে বিয়ে করবে কিনা? নীলাকে আজ সাফ সাফ এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
অফিস ছুটির পর একরকম চাপা উত্তেজনা নিয়ে অফিস ত্যাগ করলো রাশেদ। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটা দিল। গন্তব্য ধানমন্ডি লেক। লেকটা ওর অফিস থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বিশ মিনিট হাঁটতেই পৌঁছে গেল লেকের পাড়ে। ওদের পছন্দের জায়গায়। জায়গাটা লোকালয় থেকে একটু দূরে। বেশ নিরিবিলি। রোজ এখানেই ওরা গোপনে দেখা করে। গল্পগুজব করে আর আড্ডা দেয়। রাশেদ নীলার আসার পথটার দিকে লক্ষ্য রেখে ঘাসের উপর গিয়ে বসলো। নীলার আগমনের অপেক্ষায় রইলো। কিন্তু সময় যে ওর কাটছেই না। সময় কাটাতে হাতের নাগালে পড়ে থাকা ছোট ছোট ইটের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিয়ে অলস ভঙ্গিতে লেকের পানিতে ঢিল ছুড়তে লাগলো রাশেদ। আর একটু পর পর নীলার পথের দিকে ফিরে ফিরে তাকাতে লাগলো। নীলা কখন আসবে? হ্যাঁ, নীলা সত্যি এলো, প্রায় ঘন্টা খানেক দেরি করে। কিন্তু একি! নীলাকে তো ঠিক চেনাই যাচ্ছেনা! আলুথালু বেশ! নিরাভরণ! চোখের নিচে ছাই পড়েছে। মুখটা মলিন! ডাগর ডাগর চোখ দুটো কোটরে নেমে গেছে! মনে হয় কতো কাল ঘুমোয়নি ও। ওকি সেই নীলা না অন্য কেউ? আগে কখনও তো এমন হতশ্রী রূপে ওকে দেখেনি রাশেদ!
নীলা এসে চুপচাপ রাশেদের পাশে বসলো, অসাড় ভঙ্গিতে। রাশেদকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে বললো, 'তুমি কী বলবে রাশেদ, আমি তা জানি। হয়তো তুমি আমাকে যা তা ভাববে, সে-ও আমি জানি। কিন্তু বিশ্বাস করো রাশেদ। আমি নিরুপায়। আমি আমার-বাবা মা'র মনে কিছুতেই দুঃখ দিতে পারবো না। সমাজে তাঁদেরকে আমি হেয়প্রতিপন্ন করতে পারবোনা।' বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো নীলার। ওর ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠলো। চক্ষু যুগল অশ্রুসিক্ত হলো। হঠাৎ করজোড়ে রাশেদের হাতটা ধরে ওতে মাথা ঠেকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। ওর চোখ বেয়ে, গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। ভাঙাচোরা গলায় বললো, 'তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও রাশেদ। ক'দিন বাদেই আমার বিয়ে। তোমার সাথে যা হয়েছে, সব তুমি ভুলে যেও। আমাকে আর মনে রেখো না, প্লিজ।'
'না, তা হয়না! এই বিয়ে আমি মানি না। তুমি শুধু আমার। অন্য কারো হতে পারো না।' হঠাৎ চিৎকার করে বললো রাশেদ।
'চিৎকার করছো কেন? একটু বোঝার চেষ্টা করো, প্লিজ! রাশেদকে শান্ত করার চেষ্টা করলো নীলা।
'আমি কিছুই বুঝতে চাই না।' উত্তেজনায় কাঁপছে রাশেদ।
'তবে আমি আসি।' বলে উঠে দাঁড়ালো নীলা।
'দাঁড়াও।' বলে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো রাশেদ। বললো,'এত সহজেই ভুলে যাবে আমাকে? তা হতে দিচ্ছি না আমি।' বলে হঠাৎ জাপটে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো নীলাকে। নীলা সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু রাশেদের পাশবিক শক্তির কাছে ও একেবারেই অসহায়। মরিয়া হয়ে চিৎকার করে বললো, 'কী করছো? ছাড়ো! অসভ্য ইতর কোথাকার!' কী আমি ইতর? তবে দ্যাখো।' বলে অসুর শক্তিতে নীলার কোমল ঠোঁটজোড়া কামড়ে ধরে ওতে দাঁত বসিয়ে দিল রাশেদ। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো নীলা। এরপর রাশেদ বললো, তোমার অধরে আমার ভালোবাসার স্মৃতি চিহ্নটুকু এঁকে দিলাম। আমার ভালোবাসাকে আমি কোনদিন হারিয়ে যেতে দেবো না। যতদিন বাঁচবে, আমাকে মনে রেখেই বাঁচতে হবে তোমাকে। ভালোবাসায়, না হয় ঘৃণায়।'
বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিলো রাশেদ নীলাকে।
ভয়ে অপমানে কাঁপছে নীলা। নীরবে কাঁদছে। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শান্ত হয়ে এসেছে রাশেদের বিক্ষুব্ধ মনটা। প্রধান সড়কের দিকে হাঁটলো দু'জন। পাশাপাশি কিন্তু নীরবে। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। একটা রিকশা ডেকে নীলাকে রিকশায় তুলে দিলো রাশেদ। নীলা রিকশায় বসে কাঠের পুতুলের মতো চলে গেল। হাত নেড়ে হাসিমুখে বিদায় নেয়া তো দূরে থাক, একটিবারের জন্যও রাশেদের দিকে ফিরে তাকালো না। সেদিকে তাকিয়ে রাশেদের বুকের ভেতরে হাহাকার করে উঠলো।