পার্কের কুকুরগুলো রাতভর ছুটোছুটি করে ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে আমাদের মতো এখানে-সেখানে ঘুমে ডুবে যায়। তখন ঘুম ভাঙ্গে পাখ-পাখালিদের। ওরা ঘাসের উপর নেমে এসে টুপটাপ পোকা খেয়ে উড়ে উড়ে কীযে আনন্দে মাতে, ভাবা যায় না।
ফুলগুলো হেসে ওঠে প্রজাপ্রতি পেয়ে। শিশিরের ছোঁয়ায় ঘাসেরা স্নান সারে।
এমন ভোরবেলায় ইদানিং একটা মেয়ে এসে আমার ঘুম ভাঙায়।
অবাক হয়ে মনে মনে জানতে চাই, কে তুমি? কোত্থেকে আসো? কেন আসো?
মেয়েটা হাসে। আমাকে নিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসে ফ্রুট-জুস খায়। আমি ওর জন্য গাঁজর সিগারেট বানিয়ে রাখি। সেগুলো ব্যাগে পুরে দুয়েকটা টেনে উদাসী হয়ে কখনো গান শোনায়।
ওর একটাই গান, যদি জানতেম...।
আমি কখনো জানতে চাই না, ওর কিসের ব্যাথা। ও কখনো বলে, তোমার জন্য এই টি-সার্টটা এনেছি, পরতো। এরপর আমরা ঘুরতে থাকি। মেয়েটা ফুল কুড়ায়। আমি স্নান সেরে একদম তাজা হয়ে এসে রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুজনে ব্রেকফাস্ট করি।
মেয়েটা বলে, এই সকালটুকুই আমার আনন্দের।
বাকিটা সময়?
আমি ঘরে গিয়ে ঘুমাই। সন্ধ্যায় জেগে সেজেগুজে কলহাস্যে মেতে উঠি। তখন অনেক গান আর পান হয়। অনেক পুরুষ আমার পাশে বসে বলে, তুমি এতো যে সুন্দরী…!
তুমিতো সত্যি সুন্দরী, সুচারু।
শোনো, রূপ-চেতনা তোমাদের দু’চোখে। আমি একটা নিকষ কালো মেয়ে। তোমরা দেখতে পাও না। আমার জগৎটাও অন্ধকার...।
আমরা রিক্সায় চড়ি। শহরের কোলাহলে যেকোনো লোকের মতো হয়ে গিয়ে মেয়েটা বলে, নামো, আর যেতে হবে না।
তুমি কোথায় যাবে?
তা জেনে তোমার কী লাভ!
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাই। মেয়েটা হেসে টা টা দেয়। কোথায় যায়, জানা হয় না।
তারপর সারাটাদিন ওর কথা ভাবি। ভাবতে ভাবতে দুপুর গড়ায়। শপিংমলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, হাতে অনেকগুলো ব্যাগ নিয়ে ত্রস্ত পাতে বেরিয়ে যাচ্ছে! কাছে পৌঁছের আগেই গাড়িতে উঠে যায়। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।
সঙ্গে কে ছিলো লোকটা? চেনা নয় মোটেই।
সন্ধ্যা গড়ালে পার্কে গান হয়। মহুয়া-মাতাল লাগে চারদিক। তখন চুয়ানো আলোর নিচে মেয়েটাকে নেচে নেচে গাইতে দেখি—তুমিবা কার, কেবা তোমার/ এই সংসারে…। ঘোরাক্রেন্তের মতো মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাই। অনেক লোকের ভিড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়, খুঁজতে খুঁজতে সব আলো নিভে আসে।
নিবিড় আঁধারে একরাশ হতাশা নিয়ে বেঞ্চে শুয়ে থেকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, টের পাই না। প্রজাপতির ছোঁয়ায় চোখ মেলে দেখি, আমার মুখের দিকে ঝুঁকে এসে মিষ্টি করে হাসতেছে মেয়েটা!
চারদিকে নরম ভোরের আলো। আমি শিশিরে ভিজে গেছি।
ও আমাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে বলে—চলো, ফুল কুড়াবো।
ভোরের বেলায় ফুল কুড়াতে কুড়াতে ও এতো দূরে চলে যায় যে, আর চোখে পড়ে না। কি নামে ডাকবো বলো! আমি বকুল, বকুল…বলে ডাকি; তখন অনেক ফুল ঝরে পড়ে; আর মেয়েটা শিশিরে পা ভিজিয়ে চলে যায়।কোত্থেকে আসে জানা হয় না।