খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ মোমতাজ আলী খানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
- এ কে আজাদ
-
২০২৩-০৮-৩১ ১২:১৯:২৮
- Print
মোমতাজ আলী খান।খ্যাতনামা লোকসঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। একজন উঁচুমানের সঙ্গীত বিশারদ ছিলেন তিনি ।
সুমধুর সুর ও বাণীর কারণে তাঁর অনেক গানই হয়েছে জনপ্রিয়, পেয়েছে কালজয়ীর সম্মান। বাংলাদেশের সঙ্গীতের ভান্ডার সমৃদ্ধ করে যাওয়া এই খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ'র মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৯০ সালের ৩১ আগস্ট, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। প্রয়াত এই গুণি সঙ্গীতজ্ঞের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
মোমতাজ আলী খান ১৯১৫ সালের ১ আগস্ট, মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার ইরতা কাশিমপুর গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আফসার আলী খান ও মা'য়ের নাম বেদৌরা খান।
শৈশব থেকেই পিতার কলের গানে, গান শুনে শুনে, গানের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ জন্মায় মোমতাজ আলী খান-এর।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে কলকাতায় চলে যান, গান শেখার জন্য। সেখানে ওস্তাদ নিসার হোসেন খানের নিকট পাঁচ বছর গানের তালিম নেন। পরে তিন বছর ওস্তাদ জমির উদ্দিন খানের কাছে খেয়াল, ঠুমরী ও গজলের তালিম নেন তিনি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি দোতারা'সহ লোক সঙ্গীতের চর্চা করতেন।
মোমতাজ আলী খান প্রাইভেট-এ পরীক্ষা দিয়ে এন্ট্রাস পাস করেন। বিএ পরীক্ষার সময় বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন তিনি। এরপর তাঁর আর এই পরীক্ষা দেয়া হয়নি।
মোমতাজ আলী খান এক সময় ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর সহায়তায় কলকাতার সং পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩২ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর কণ্ঠে "ওরে শ্যাম কেলে সোনা" এবং "আমি যমুনাতে যাই বন্ধু" গান দুটি প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি লাভ করেন। এর ফলে প্রথমে 'অল ইন্ডিয়া রেডিও' ও পরে ১৯৩৩ সালে 'কলকাতা বেতার'-এর সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৩৪ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে, মোমতাজ আলী খান শান্তিনিকেতনে যান। কবিগুরু তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন। একই বছরে কলকতা বেতারে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে কবি জসীম উদ্দীন ও কাশেম মল্লিকের সাথে পরিচিত হন। কবি জসিম উদ্দীনের বহু গানে সুরারোপ করেছেন তিনি। কাশেম মল্লিকের মাধ্যমে মোমতাজ আলীর সাথে, কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয় ঘটে। কাজী নজরুল ইসলাম, তাঁকে দিয়ে দুটি ইসলামী গানের রেকর্ড করান। ১৯৩৫ সালে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও তাঁর নিকট দুই বছর সরোদে তালিম নেন মোমতাজ আলী খান ।
১৯৪৬ সালে মোমতাজ আলী খান কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বেতারের নিজস্ব শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে তিনি সাউথ ইস্ট এশিয়ান সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। ১৯৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল একাডেমির আর্টস একাডেমিতে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যোগ দেন।
কলকাতায় থাকাকালীন সময়ে, সেখানকার কয়েকটি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন মোমতাজ আলী খান।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও গায়ক, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি যেসব চলচ্চিত্রে গায়ক, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন তারমধ্যে- আকাশ আর মাটি, সাত ভাই চম্পা, বেদের মেয়ে, অরুন বরুন কিরনমালা, রূপবান, জোয়ার ভাটা, যে নদী মরু পথে, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, লালন ফকির, নিমাই সন্ন্যাসী, দয়াল মুর্শিদ, অনেক দিন আগে, এক মুঠো ভাত, অন্যতম। এরমধ্যে কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছেন।
মোমতাজ আলী খান রচিত খুবই জনপ্রিয় ও বিখ্যাত একটি গান- "গুন গুনা গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়", যা ১৯৭৫ সালে খান আতাউর রহমান নির্মিত 'সুজন সখী' চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়। তাঁর লেখা-সুর করা আরেকটি কালজয়ী গান 'এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া', আবদুল আলীম-এর গাওয়া এই গানটি ভূবনবিখ্যাত হয়ে আছে।
মোমতাজ আলী খানের সুর করা আরো উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলো - আগে জানি নারে দয়াল..., নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে রে ভ্রমরা..., চারাগাছে ফুল ফুইটাছে..., উজান গাঙের নাইয়া..., আমায় নিয়া যারে সোনার মদিনায়...., প্রভৃতি ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মোমতাজ আলী খান, বহু উদ্দীপনামূলক গান রচনা করেন এবং সুরারোপ করেন। তাঁর রচিত 'বাংলা মায়ের রাখাল ছেলে', 'বাংলাদেশের মাটি ওগো' গানগুলো তখনকার সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে, ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনে লোকসঙ্গীত বিভাগ খোলা হলে, তিনি এই বিভাগের দায়িত্ব নেন এবং সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে লোকসঙ্গীত শেখান মোমতাজ আলী খান।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করে গেছেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গীত পরীক্ষার, অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন তিনি।
ব্যক্তিজীবনে মোমতাজ আলী খান ১৯৪৩ সালে, সঙ্গীতশিল্পী কাজল খানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ছয় কন্যা সন্তান, সকলেই সঙ্গীতশিল্পী। এদের মধ্যে পিলু মমতাজ, সত্তর ও আশির দশকে দেশীয় পপসঙ্গীতে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
বাংলাদেশের সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য মোমতাজ আলী খান পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁরমধ্যে আছে- ১৯৭৭ সালে গীতিকবি সংসদ পদক, লোকসঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৮৬ সালে কালু শাহ পদক। এছাড়াও- জাতীয় রবীন্দ্র পরিষদ পদক, লালন একাডেমী পদক, নজরুল একাডেমী পদক, পতাকা পদক, মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সঙ্গীত একাডেমী পদক, প্রভৃতি।
সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, গায়ক, সংগীত শিক্ষক মোমতাজ আলী খান। তিনি চলচ্চিত্রের গান, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, লোক সঙ্গীত, ধ্রুপদী, রাগ সব ধরণের গানই করেছেন সমানভাবে। তিনি বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারতেন। একজন উঁচুমানের সঙ্গীত বিশারদ ছিলেন তিনি, গানের প্রতিটি শাখায় রেখে গেছেন সৃজনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর । সুমধুর সুর ও বাণীর কারণে তাঁর অনেক গানই হয়েছে জনপ্রিয়, পেয়েছে কালজয়ীর সম্মান। যা এখনও দর্শক-শ্রোতাদেরকে বিমোহিত করে, উদ্বেলিত করে।
বাংলাদেশের সঙ্গীতের ভান্ডার সমৃদ্ধ করে গেছেন এই খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ মোমতাজ আলী খান, তাঁর সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন- যুগের পর যুগ ধরে।