মৃদুলা অফিস থকে ফিরে দেখলো প্রতীক রান্নাঘরে পেঁয়াজ কাটছে আর পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখ নাক দিয়ে জল পড়ছে।
মৃদুলা বললো, কি ব্যাপার আজ তুমি রান্নাঘরে?
আজ তোমাদের জন্য এমন একটা দারুণ ডিশ বানাবো
যা খেয়ে তোমরা মা ছেলে দুজনেই আমাকে বাহবা না দিয়ে পারবেনা।
ওরে বাবা তাই নাকি? তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে পারবো। খিদেও পেয়েছে
আমি তো তোমার মতন এক্সপার্ট রাঁধুনি নই, তাই আমার সময় লাগবে। ততক্ষণ আমরা একটু কফি আর কুকিজ খাই।
মৃদুলা মনে ভাবে এমনি সময় মানুষটা এতো লাভিং হাজবেণ্ড আর বাবা। কিন্তু ছেলের ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রিতে নম্বর কম হলেই ছেলেটাকে কুকুরের মতন মারতে থাকে, মৃৃদুলা বাধা দিতে গেলে তার পিঠেও দু এক ঘা পড়ে যায়না যে তা নয়।
এরপর একমাস পরে তাতাইয়ের মিড টার্ম পরীক্ষার রেজাল্ট বার হল। তাতাই সব সাবজেক্টে টপার শুধু
ওই দুটো সাবজেক্টেই নম্বর হাইস্টের দু তিন নম্বর কম।মা আর ছেলে তো ভয়ে কাঁপছে। বাবা এসেই বিভত্স মার মারবে। মৃদুলা বললো এবার যদি সেরকম কিছু করে তবে আমি তোকে নিয়ে আমার কেনা ফ্ল্যাটে চলে যাবো।
ঠিক তাই হল ওই দুটো সাবজেক্ট নম্বর কম দেখে কোমড়ের বেল্টটা খুলে সপাসপ ছেলেকে মারতে লাগলো। মৃদুলা এবার কড়া হয়ে প্রতীকের হাগদুটো শক্ত করে ধরে বললো,খবরদার বলছি আমার ছেলের গায়ে যদি হাত দাও তবে ফল খুব খারাপ হবে,
কি খারাপ হবে শুনি?
এমনিতেই আমি আর তাতাই আলোচনা করছিলাম এবারও যদি তুমি আমাদের জন্তু দের মতন মারো তবে কালই আমরা আমার ফ্ল্যাটে চলে যাবো। তোমার বাবা মা কে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে যে একটা পাগল ছেলের বিয়ে দিলেন কেনো? তোমার বন্ধুদের গিয়ে জিজ্ঞেস কর কেউ তাদের ছেলেকে কোন দু একটা সাবজেক্টে সামান্য দুই এক নম্বর কম হলে এভাবে মারে না কি? তোমার মেন্টাল সমস্যা আছে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ হও আগে তারপর আবার বিয়ে করো। আমি আর আমার ছেলে কিছুতেই এখানে থাকবোনা।
মা বেরিয়ে হাঁপিয়ে বিছানার ওপর বসে পড়ে তাকে বললো তুই একদম চিন্তা করিস না তাতাই আমি তোর পছন্দের সাবজেক্টই তোকে পড়াবো। কাউকে এক পয়সাও দিতে হবেনা, আমার রোজগারে আমি তোকে পড়াবো।
আমি একটুও চিন্তা করছিনা মা, কিন্তু তুমি আমার জন্য চিন্তা করতে গিয়ে এই বাজে লোকটার হাতে মার খেয়ে মরছো।
হ্যাঁ কি বললে তুমি? ছেলের ইচ্ছায় ছেলেকে পড়াবে? আমি যখন বলেছি তখন জয়েন্টে ওকে বসতেই হবে। আমি জয়েন্টে পঞ্চম স্থান পেয়েছিলাম কেনো আমার ছেলে পারবেনা! ।
আরে! ও যখন একটা ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট নিয়ে আসবে তখন তুমি ক্লাবে গিয়ে সবাইকে গর্বের সাথে বলতে পারবে আমার ছেলে জয়েন্টে ব্রলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছে।
কিন্তু ওর মন প্রাণ দিয়ে ইকোনমিক পড়ে ইকোনমিস্ট হতে চাইছে, অমরত্ব সেন ওর আইডল তাছাড়া ওর ভালো লাগেনা ফিজিক্স কেমিস্ট্রি এই গুলোর মধ্যে ও কোনো রস পায়না পড়তে, তুমি কেনো ওকে পড়া নিয়ে ওর সাথে যুদ্ধে নামছো?
যুদ্ধ তো ওর সাথে নয় যুদ্ধ আমার সাথে তোমার,
কেনো আমার সাথেই বা তোমার যুদ্ধ কিসের?
হয়তো ও ইন্জিনিয়ারিং পড়তে পাড়তো, তুমি যেহেতু নিজে ইকনমিক্স নিয়ে পাস করে আই সি আই ব্যাঙ্কে উচু পোস্টে রয়েছো তাই তুমি তোমার ছেলেকে জোর করে ইকোনমিক্সের দিকে ঠেলে দিচ্ছ ইচ্ছে করে যাতে আমাকে ও অবজ্ঞা করতে পারে।
মৃদুলা জোর গলায় বললো, তা যদি হত তবে অনেকদিন আগেই তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম। দিনের পর দিন ছেলেকে বুঝিয়েছি তোমার বাবার এতো সখ তুমি জয়েন্টে বস। জয়েন্টে পড়ার জন্য ওকে বেস্ট টিউশন দিয়েছিলাম।কিন্তুও প্রতিদিন মনমরা করা আসতো, এবার বল দায় কার?
কাধ ঝাঁকিয়ে প্রতীক বললো সারাদিন অফিস প্রচণ্ড পরিশ্রম করে নানারকম কাজ করে ক্লাবে যেতে না পারলে আমি ছেলে পড়াতে বসতে পারবোনা ছেলেটা মার খেয়ে মরতো।
এবার প্রতীক এসে হাত ধরে বলে, দেখো মৃদুল তুমি যদি ওকে ছোটো থেকে ফিজিক্স কেমিস্ট্রির দিকে জোর দিতে তাহলে হয়তো জয়েন্টে অনেক ভালো রেজাল্ট হত।
মৃদুলা নিশ্বাস ফেলে বললো তুমি থাক তোমার চিন্তা ভাবনা নিয়ে, অতই যদি ছেলের পড়াশোনা নিয়ে চিন্তা, তাহলে আমার সাথে তোমাকেও যোগ দিতে হত। পড়নো তে।
আমরা কাল চলে যাচ্ছি আমার কেনা ফ্ল্যটে। ওই ফ্ল্যট তোমার ফ্ল্যাটের থেকে ডবল। অনেক সহ্য করেছি আর নয় এবার আমরা মা ছেলে স্বাধীন থাকবো। তুমি কি ভাবো তুমি যে সামান্য টাকা সংসার খরচের জন্য দাও তাতে সব হয়ে যায়! বাকি টাকাতো আমার রোজগারে চলে।
মৃদুল, উল্টোপাল্টা কথা বলোনা , আমি বারণ করছি, আবার মার খেয়ে যাবে।
এই কথা শোনার সাথে সাথে তাতাই ছুটে এসে শক্ত করে বাবার হাত ধরে ফেলে অনেক হয়েছে, আর একবার তুমি আমার মায়ের গায়ে হাত তুলে দেখো, তাহলে আমি ভুলে যাবো যে তুমি আমার বাবা। তাতাইয়ের মুষ্টির জোর অনেক জিমে যাওয়া প্রতীক তার কাছে হেরে গেলো,
বাধ্য হয়ে ছেলেকে বললো, ছেড়ে দে বলছি আমার লাগছে,
লাগছে না আমাকে কুকুরের মতন বেল্ট দিয়ে যতটা মেরেছিলে, মায়ের গায়ে সাঁই সাঁই করে যখন বেল্টের বাড়ি চালিয়ে ছিলে তার চেয়ে বেশি লাগছে?
ছেড়ে দে তাতাই আমার ভুল হয়ে গেছে? তুমি মানুষ? কেউ নিজের ছেলেকে জয়েন্টে চান্স না পাওয়ার জন্য এভাবে মারে?
পরের দিন ভোরবেলা থেকে মা ছেলের গুছানো আরম্ভ হল।মুভার্স এণ্ড পেকার্স কে খবর দিয়ে সব জিনিসপত্র তুলে দিল। বিয়ের খাট, আলমারি ড্রেসিং টেবিল সোফাসেট, মৃদুলার নিজের রোজগারে কেনা ফ্রিজ তুলে দিলো। নতুন ফ্ল্যাটে গিয়ে টিভি, মাইক্রো ওভেন সব ধিরে সুস্থে কিনে নেবে। হঠাৎ প্রতীক উঠে দেখে ঘড়িতে সারে আটটা বাজে, কই মৃদুলাএসে চা দিয়ে ডেকে দেয়, আজ ডাকলোনা তো! তবে কি ওরা সত্যি চলে যাচ্ছে?
বাইরে এসে দেখে ঘর সব খালি,?
মৃদুলা বললো চলে যাচ্ছি আমার নিজের ফ্ল্যাট।
সে তোমরা যাবে যাও, জিনিসপত্র সব নিয়ে যাচ্ছ কার হুকুৃমে?
হুকুম মানে! আমার বিয়েতে দেওয়া ফার্ণিচারগুলো আর আমি আমার নিজের রোজগারে কেনা ডবল ডোর ফ্রিজটা। যা তুমি কিনেছিলে তা রেখেই যাচ্ছি। এই বলে মৃদুলা তার আর তাতাইয়ের জিনিসপত্র গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।
সকসলের চা-টা ও কি পাবোনা?
আছে তো সব করে খাও। আর হ্যাঁ খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স নোটিশ পাবে। আমার আর ছেলের মারের দাগ গুলো থানায় দেখিয়ে একটা ডায়েরি করে যাব।
প্রতীক থুম হয়ে বসে ওদের চলে যাওয়া দেখালো।
এরপর পাঁচ ছয় বছর মা ছেলের খুব নির্বিঘ্নে কাটলো। তাতাইয়ের পড়াশোনা খুব ভালোই এগোচ্ছে । প্রেসিডেন্সি তে ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ে ইউনিভার্সিটিতে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হল। চলে গেলো মায়ের প্রেরণায় লণ্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে পি এইডি করে ফিরে এলো বাড়ি।যেদিন তাতাই আসবে মৃদুলার কি ব্যস্ততা, তাতাইয়ের ঘরের বেডকভার সাথে ম্যাচ কারে জানলার পর্দা, ঝাঁ চকচকে বাথরুম। নিজে হাতে সব পরিস্কার করেছে। ওর পছন্দের সব খাবার বানিয়ে এয়ারপোর্টে চলে গেলো ছেলেকে আনতে। আনন্দের চোখের জলে মিলন হল মা ছেলের । অসাধারণ রিসার্চ ওয়ার্ক করেছে বাংলার ছেলে অর্কজিত মুখার্জি। টিভিতে দেখছে একা বসে প্রতীক।
বহুকষ্টে ফোন করলো মৃদুলা কে, ফোনে বললো তুমিই জিতে গেলে। হয়তো আমার থেকে আলাদা হয়েই তাতাইয়ের এই সাফল্য, তাতাইকে একবার ফোন টা দেবে?
দেখছি?
কিছুক্ষণ পরে তাতাই এসে ফোন ধরে বললো, বলুন মিঃ মুখার্জি?
তুই আমাকে বাবা বলেও ডাকবিনা? আমার বাবা বলে কেউ ছিলো বলে মনে পড়েনা বাবা বলে কেউ ছিলো আমার? আমার সব কিছু সাফল্য মাকে ঘিরে। তাই দয়া করে আপনি আর নতুন করে বাবা হওয়ার চেষ্টা করবেন না। আমার শুধু মনে আছে সপাসপ বেল্টের বাড়ির কথা যার দায় আজও বহন করে চলেছি আপনার মারের ফলে আমার নার্ভ ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল। আমার মাকে এই নার্ভের চিকিৎসার জন্য বহু অর্থ খরচ করতে হয়েছিল, এখনও ওষুধ খেতে হতে হয়। আমার মা আমাকে দুহাতে আগলে জীবনের প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজাটা খুলে দিয়েছে।
আর কোন সম্পর্ক আপনার সাথে রাখতে চাইনা। হ্যাঁ যখন তখন ফোন করে আমাদের ডিস্টার্ব করবেন না।
প্রতীক আজ একা শূন্য বাড়িতে বসে হিসেব করে যায় দিন-রাত। ওর এক বোন বিধবা হয়ে ওর দেখাশোনা করে।
বোন স্বপ্না জিজ্ঞেস করে কি এতো হিসাব কর দাদা?
কত কি হিসাব বাকি,
তোরা বুঝবিনা আমার সমস্ত জীবনের হিসাবটাই যে বাকি থেকে গেছে রে,
স্বপ্না আর কিছু বললো না।
শুধু প্রতীকের গলায় আক্ষেপের কথা শোনা যায় বিরবির করে বলে যায়, যার সব আছে তার কিছু নেই।