দশ হাজার টাকা পাঠিয়ে পলাশ ফোনে বললো,
--আর কতদিন তোমার বোন মানে আপার বাড়িতে থাকবে? তুমি তোমার বাবার বাড়িতে আজ চলে যেও।আমি অফিস শেষ করে ওখানে যাবো।
আমি মৃদু হেসে বললাম,
--আচ্ছা ঠিক আছে।
পলাশের সাথে রাগ করে সপ্তাহখানেক হলো এখানে এসেছি।এতোদিন আমি রাগ করে কথা বলিনি এবং পলাশ নিজেও ফোন দেয়নি।আজ হঠাৎ টাকা পাঠিয়ে বললো বাবার বাড়িতে যেতে।ও অফিস শেষ করে ওখানে আসবে।সংসার জীবনে কিঞ্চিৎ রাগারাগি হয়ই।আমাদেরও তাই হয়েছে।আমি যেবার উচ্চ মাধ্যমিক দেই তখনই পলাশকে বিয়ে করি।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে আপার বাড়ি থেকে বের হয়েছি বাবার বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।বাসে উঠলেই খানিকটা বমি'র সমস্যা হয় আমার।তাই পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।আপা একটা আমসত্ত্ব ধরিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে একটু মুখে দিয়ে বসেছি।
পলাশ কিছুক্ষণ পরপর ফোন দিচ্ছে আর জানতে চাচ্ছে কতটুকু এসেছি!মাঝেমাঝে পলাশের অতিরিক্ত যত্নশীল আচরণগুলো খুব বিরক্ত লাগে।কিন্তু কেন জানিনা আজ ভালো লাগছে।
খুব গরমে চলন্ত বাসের জানালায় আলতো করে মাথা রাখলে যে বাতাসটা চুল উড়ায়,যে বাতাসটা শীতল অনুভব করায় ঠিক তেমন ভালোলাগার মতো কাজ করছে কিছুক্ষণ পরপর করা পলাশের ফোনের যন্ত্রণাটা।
আমার পাশের সিটে যে ভদ্রমহিলা বসেছেন খানিক বাদে উনাকে আপাদমস্তক দেখলাম।চেনা চেনা লাগছিলো খু্ব! হঠাৎ মনে পড়লো উনি একসময় ভার্চুয়ালে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলেন।ঐ সময়ের বেশ জনপ্রিয় লেখিকা ছিলেন।আমি ভীষণ সাহিত্যপ্রেমী মানুষ।সেই সুবাদে উনাকে আরও বেশি করে চেনা।যদিও কখনো কথা হয়নি তবে উনার লেখা পড়তাম।
নাম ফালাক,লম্বায় বোধহয় ৫'৮ এবং গায়ের রং ধবধবে ফর্সা।
উনার যে বয়ফ্রেন্ড ছিলেন সেও আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলেন।দুইজনের প্রেম, মায়ায়ঘেরা যুগলবন্দী ছবি যেনো এখনো আমার চোখে ভাসে।উনার বয়ফ্রেন্ড ছিলো আমাদের এখানকারই বাসিন্দা।
তারপর তাদের কি জানি হলো!দুইজন দুইপথ বেছে নিলো।যদিও পরবর্তীতে শুনেছি উনাদের বনিবনা হচ্ছেনা।ভদ্রলোক আর ফালাক দুজন দুই মেরুর মানুষ ছিলো।ভদ্রলোকের ধর্মের প্রতি টান ছিলো আর ফালাক ছিলো স্বাধীনচেতা মানুষ।যখন যা খুশি তাই করতো।রাত করে বাড়ি ফেরা থেকে শুরু করে সে লিভইন রিলেশনেও জড়িত ছিলো। তাদের সম্পর্কের সেবারই সমাপ্তি ঘটে।
অথচ আজ ফালাককে দেখলাম হিজাব এবং বোরখায়।যদিও মুখখোলা ছিলো।তাই দেখা মাত্রই চিনতে পেরেছি।
আমি জানিনা সেই ভদ্রলোক বা আমার পাশের সিটে বসে থাকা ফালাক সুখে আছে কিনা বা এখন কেমন আছে?
বাড়িতে পৌঁছে পলাশকে ফোন দিলাম।সে ফেন ধরতেই বললাম,
--আমি বাবার বাড়িতে এসো পৌঁছালাম। তুমি কখন আসবে?
উত্তরে সে বললো,
--তুমি আমার সাথে রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলে।আমার দায়বদ্ধতা ছিলো সেখানে।এখন আমি যেভাবেই হোক তোমাকে তোমার বাবা মায়ের নিকট সুস্থভাবে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।এখানে আমার দায়বদ্ধতা শেষ।আমার সাথে আর কখনোই তোমার যোগাযোগ হবেনা।ভালো থেকো।
এতটুকু বলেই পলাশ ফোন রেখে দিলো।এবং ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপ,ইনস্টাগ্রাম,নাম্বার সবকিছু থেকেই সাথেসাথে আমায় ব্লক করে দিলো।
এরপর বুঝলাম যে,আমাদের দেড়বছরের প্রেম, প্রায় সাড়ে তিন বছরের সংসার,সব মিলিয়ে পাঁচ বছরের সম্পর্কের এখানেই সমাপ্তি ঘটলো।
**
এরপর আরও প্রায় তিনবছর কেটে গেলো।
জানেন তো,আল্লাহ মানুষকে খালিহাতে দুনিয়ায় পাঠায় না।কতগুণ দিয়ে যে পাঠায় সেটা এ-ই পাঁচবছরে আমি শিখেছি।ভালো হাতের কাজ পারতাম সেই সুবাদে উপার্জন করে চলে যাচ্ছিলো সময়,আলহামদুলিল্লাহ।
মা বাবা প্রায় বলতেন পলাশকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন করে সংসার করার চিন্তাভাবনা করতে।কিন্তু সংসার করার চিন্তাভাবনা আর আসেনি মাথায়।পলাশের সাথেও আর যোগাযোগ হয়নি।সম্পর্কটা শেষ হয়েও যেনো ঝুলে রইলো!মনে হতো,কোথায় যেনো ভালোবাসাটা রয়েই গেলো!
গত বৃহস্পতিবার বোনের বাড়িতে গিয়েছিলাম।তিনদিন থাকার পর আজ বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম।
আমার পাশের সিটে এক তরুণী বসলো।বারবার কেউ একজন ফোন দিচ্ছিলো।আর সে কতটুকু এসেছে তা জানানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে।কথাবার্তা শুনে বুঝলাম ফোনের বিপরীতে আছে তার বর।
হঠাৎ সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো।বারবার পলাশের ফোন,পাশের সিটের ফালাক,বাড়ি ফিরে পলাশের বলা কথাগুলো, পুরোনো সবকিছুই নতুন করে মনে পড়লো।
ভাবছি,আমার পাশের সিটের মেয়েটার সাথেও কি এমন কিছু হতে পারে! না, না। আল্লাহ মাফ করুক।দু'আ করি মেয়েটা সুখে থাকুক।
আমার গন্তব্য আসতেই বাস স্টেশনে নামলাম।
আমায় নামিয়ে দিয়েই বাস চলে যাচ্ছে।
অথচ আমি পড়ে রইলাম সেই ছেড়ে আসা সংসারে, সেই দিনটিতে,সেই কথাগুলোতে।
রিকশায় উঠতে গিয়ে থেমে গেলাম।সামনে পলাশ দাঁড়িয়ে আছে।পলাশের হাত ধরে তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশের সিটের সেই তরুণী! একই জায়গায় সে যে নেমেছে তা তখন খেয়াল করিনি।
পলাশ আমায় দেখতেই চোখ নামিয়ে নিলো।বুঝলাম যে,আমার প্রয়োজন তার জীবনে অনেক আগেই ফুরিয়েছে!
রিকশা চলছে নিজ গতিতে।পলাশকে ডিভোর্স দেওয়ার সময় এবার এসেই গেলো!
হায়রে সংসার,প্রিয় মানুষ,ভালোবাসা,হায় আমি!
আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,আমি এতো অসহায় কেন, আল্লাহ?
টুং করে আমার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো একটা বার্তা।"আমায় ক্ষমা করে দিও"
আসলে এ-ই মানুষগুলো ক্ষমার যোগ্য নয়।তবুও তাদের ক্ষমা করতে হয় নিজের জন্য স্রেফ নিজের ভালো থাকার জন্য। আমিও বোধহয় পলাশকে একদিন ক্ষমা করে দেবো।